টানা ১২ বছর ধরে অন্ধদের জন্য চলচ্চিত্র বর্ণনা করা মেয়ে চু ইং
2022-08-05 20:09:12

আজকের অনুষ্ঠানে আমরা অন্ধদের জন্য চলচ্চিত্র বর্ণনা করা একটি মেয়ের কাহিনী আপনাদের জানাবো। তিনিই চু ইং। তিনি একটানা ১২ বছর ধরে অন্ধ ব্যক্তিদের ‘সিনেমা দেখতে’ সাহায্য করে আসছেন। বিগত ১২ বছর ধরে চু ইং তাদের ‘চোখ’ হয়ে উঠেছেন, আবেগপূর্ণ পদ্ধতিতে বর্ণনা করে প্রতিটি অন্ধ বন্ধুর হৃদয়ে সিনেমার ছবি পৌঁছে দিয়েছেন।

বিগত ১২ বছরে, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের আরও ভালোভাবে সেবা করার জন্য চু ইং শুধুমাত্র সিনেমাকে আরও ভালোভাবে বলার বিষয়ে চিন্তা করেননি, বরং ভালবাসার শক্তি দিয়ে ‘আলো ও ছায়া হার্ট পডকাস্ট’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক দলও গঠন করেছেন।

কয়েক ডজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে বসে চু ইং তার হাতে মোটা স্তূপের পাণ্ডুলিপির কাগজ ধরে রাখেন। তিনি কখনো বড় পর্দার দিকে তাকাতেন, আবার কখনো নোটের দিকে তাকাতেন। চলচ্চিত্রের মসৃণতা নিশ্চিত করার জন্য চু ইংকে অবশ্যই কথার গতি ও ছন্দ নিয়ন্ত্রণ করতে হতো। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দর্শকদের মুভিটি বোঝানোর জন্য তিনি প্রায়শই একটি মুভিকে কয়েক ডজনবার বা এমনকি শতবার দেখেছেন।

 

চু ইং বলেন, সবথেকে কঠিন বিষয় হল- মুভি বারবার দেখতে হয়। আমার মনে হয়, সব সময় দেখি। আর একটা মুভি দশ-বিশ মিনিটে দেখা যায় না। এক বা দুই ঘণ্টা লাগে, যা অনেক সময়সাপেক্ষ বিষয়। দেখা শেষ হওয়ার পর প্রতিটি দৃশ্যকে সংযুক্ত করতে হবে, তাই মুভিটি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে হবে।

২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করে চু ইং তার নিজ জন্মস্থান নিংপোতে ফিরে যান এবং একজন সমাজসেবী হন। তিনি সর্বদা জনকল্যাণকর বিষয়ে উত্সাহী ছিলেন। চাকরির ফাঁকা সময়ে তিনি স্বেচ্ছাসেবক পরিষেবার কাজে নাম অন্তর্ভুক্ত করেন এবং অন্ধদেরকে চলচ্চিত্র বোঝাতে শুরু করেন।

তিনি বলেন, এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে ভাগ্য লাগে। আমার দাদি ছোটবেলায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন। তার চোখে ছানি ছিল, যা তাকে আরও বেশি দেখার সমস্যায় ফেলেছিল। যখন তার বয়স ৭০ ও ৮০ বছর হয়, তখন তিনি দেখতে পেতেন না। তখন তিনি আমাদের নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করতেন। তার সাথে আড্ডা দেওয়া, খবরের কাগজ পড়া এবং টিভির নানা ছবি নিয়ে কথা বলতাম। হয়তো এই কাজ- আমার দাদির প্রভাব থেকে, আমার হৃদয়ে এখনও এই ধরনের মানুষের প্রতি একটি বিশেষ অনুভূতি আছে।

তারপর থেকে চু ইং ফিল্মে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং মুভি ব্যাখ্যা করার কৌশলগুলো নিয়ে গবেষণা করে থাকেন।

সেই সময় আমি প্রথম যে মুভিটি ব্যাখ্যা করেছিলাম, তা হল চাং ইমৌয়ের পরিচালিত ‘অ্যালাইভ’। এই বিশেষ মুভিটি ভালোভাবে বলার জন্য আমি সত্যিই বিশ বা ত্রিশ বার দেখেছি। সম্পাদনা শিখতেও শুরু করেছিলাম আমি।

কেন আমি সম্পাদনা শিখতে শুরু করেছি? কারণ একটি সাধারণ সিনেমার মতো এর দৈর্ঘ্য বেশিরভাগই দুই ঘণ্টা থেকে আড়াই ঘণ্টা, কিন্তু আমি খেয়াল করেছি যে, অন্ধ বন্ধুরা লম্বা দৈর্ঘ্যের দৃশ্যে সম্পূর্ণরূপে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে পারেন না। তাই আমি সিনেমার সারাংশ বোঝার চেষ্টা করতাম।

 

আমি যখন কথা বলছিলাম, কথার মাঝখানে আমাকে বিরতি দিতে হয়েছিল। কারণ আমার তাদের কাছে সিনেমার দৃশ্য বর্ণনা করা দরকার। আমি আঞ্চলিক ভাষায় তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে পছন্দ করি।

প্রথমবার চলচ্চিত্র ব্যাখ্যা করার প্রক্রিয়া নিখুঁত না হলেও অন্ধ বন্ধুদের উত্সাহ তাকে চালিয়ে চালিকাশক্তি যুগিয়েছে। চু ইং বলেন, প্রথমবার মঞ্চের নীচে শতাধিক অন্ধ মানুষের মুখোমুখি হয়ে আমি অনেক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। আস্তে আস্তে আমি আবিষ্কার করি যে, চলচ্চিত্রের দৃশ্য পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা কখনও কখনও ভ্রুকুটি করতো, কখনও কখনও তারা হাসতো, এবং আমি ভাবছিলাম যে, তারা এটি বুঝতে পেরেছিলেন এবং সিনেমার দৃশ্যের সাথে অনুরণিত হয়েছিলেন। মুভি শেষ হওয়ার পর চাং নামের এক খালা উত্তেজিত হয়ে আমার কাছে আসেন। তিনি আমাকে বললেন, আমি সত্যিই এটি দেখেছি। তখন আমার মনে হল, উনি বেশ শিশুর মত উত্তেজিত।

 

বছরের পর বছর ধরে চু ইং অনেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে, ৭২ বছর বয়সী হান পেইলি তাদের মধ্যে একজন। হ্যান পেইলি জন্মগত চোখের ছানিতে ভুগছেন। ২০১৬ সালের পর, তার দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে। তিনি প্রতিদিন নিজেকে ঘরে বন্দী করে রাখতেন এবং বাইরে যেতে চাইতেন না। পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার পর চু ইং যখনই সময় পেতেন, তখনই বৃদ্ধার সাথে কথা বলতে তার বাসায় যেতেন। চু ইং তাকে চলচ্চিত্রে দেখতে নিয়ে যাচ্ছেন শুনে হান পেইলি প্রথমে খুব অসন্তুষ্ট হন এবং অনুভব করেছিলেন যে, তিনি একজন মিথ্যাবাদীর সাথে দেখা করেছেন।

 

হ্যান পেইলি বলেন, তিনি আমাকে সিনেমা হলে নিয়ে গেছেন এবং আমি খুব খুশি ছিলাম না। কারণ, আমি দেখতে পারিনি, তাহলে আমি কীভাবে একটি সিনেমা দেখতে পারি। পরে, তিনি মুভি’র গল্পটি খুব প্রাণবন্তভাবে বলেন, যেন এটি আমাকে সিনেমার মতোই দেখতে পাই। তিনি খুব সুন্দরভাবে বলেছিলেন। আমি তাকে বললাম, আপনি আমাকে মিথ্যা বলেননি, আমি সত্যিই অন্য এক ব্যক্তিকে পরিবর্তন করেছি বলে মনে হচ্ছে এবং আমি খুব খুশি।

চু ইং বলেন, মুভি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি খুব মনোযোগী। তিনি আশা করেন, তার ব্যাখ্যা করা প্রতিটি মুভি অন্ধ মানুষদের মনে প্রবেশ করতে পারে এবং তাদের জীবন আলোকিত করতে পারে।

যখনই একজন নতুন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সিনেমা দেখার পর চু ইংকে বলেন যে, তারা তাদের জীবনে প্রথমবার প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করেছেন, চু ইংয়ের হৃদয়ে ব্যথা অনুভব হয়েছিলো। তিনি আরও বেশি সচেতন হয়ে উঠছেন যে, আরও বেশি লোককে সাহায্য করার জন্য শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত শক্তির উপর নির্ভর করা যথেষ্ট নয় এবং আলোর এই রশ্মিকে একটি রিলের মাধ্যমে প্রতিসৃত করা দরকার।

গত বছর, তিনি ‘লাইট অ্যান্ড শ্যাডোর হার্ট পডকাস্ট’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক সেবা দল গঠন করেছিলেন এবং এখন স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা ৩০ জনেরও বেশি হয়েছে। তারা আলাদা আলাদাভাবে ফিল্ম এডিটর, ফিল্ম ধারাভাষ্যকার, অন্ধ এসকর্ট, কেয়ারিং টিম মেম্বারের দায়িত্ব পালন করেন। প্রত্যেকেরই শ্রমের সুস্পষ্ট বিভাজন রয়েছে, যা স্বেচ্ছাসেবক সেবার দক্ষতাকে ব্যাপকভাবে উন্নত করে।

চু ইং বলেন, আমার এখন মুভি সম্পাদনা করার দরকার নেই। আমি শুধু মুভি এডিটর বলি, আমি কি চাই। মুভি ব্যাখ্যা করার আগে এবং পর সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবক অন্ধ লোকের সঙ্গে থাকবে। তাদের জন্য একটি অনুষ্ঠান করতে তাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি চালাতে হতো। এখন আমাদের একটি গাড়ি দল আছে এবং চালকও আছে।

শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে চলচ্চিত্র বলার ধরণগুলোও সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। আগে চু ইংকে ঘটনাস্থলে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এখন ব্যাখ্যার বিষয়বস্তু আগে থেকে রেকর্ড করা যায়, এডিট করা যায় এবং ফিল্মে সংযুক্ত করা যায়। এটি শুধুমাত্র কাজের দক্ষতাই নয় বরং একাধিকবার পুনরায় ব্যবহার এবং ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে।

 

এই বছরের শুরুতে নিংবো ইউনিভার্সিটির কয়েক ডজন সাংবাদিকতা শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবক সেবা করতে তার দলে যোগদান করেছে। চলচ্চিত্র নির্বাচন, কপিরাইটিং থেকে রেকর্ডিং এবং সম্পাদনা পর্যন্ত, প্রত্যেকেরই শ্রমের একটি স্পষ্ট বিভাজন আছে এবং একসাথে কাজ করে।

উই মিও লিং নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, শুরুতে সিনেমা বেছে নেওয়ার সময় আমরা দীর্ঘ সময় ধরে চিন্তা করেছি, কারণ আমরা জানতাম না কোন ধরনের সিনেমা বাছাই করবো। ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে চু ইংয়ের বহু বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে আমরা তার সঙ্গে পরামর্শ করতে পছন্দ করি।

স্বেচ্ছাসেবীর উদ্দীপনার সঙ্গে শিক্ষার্থীরা প্রতিটি শব্দকে যত্ন সহকারে বিবেচনা করে এবং প্রতিটি বিষয়ে বিশদ পুনরাবৃত্তি করে, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ‘দেখার’ অভিজ্ঞতা জানা যায়।

তরুণদের অংশগ্রহণ এবং অবদান দেখে চু ইং তৃপ্তি বোধ করেন। তিনি আশা করেন ভবিষ্যতে আরও সঙ্গী আবির্ভূত হবে, যাতে আরও বেশি সংখ্যক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী চলচ্চিত্র থেকে জীবনের আনন্দ এবং আশা অর্জন করতে পারে।