সম্প্রতি চীন ও বাংলাদেশের সহযোগিতায় দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কারখানা তথা কক্সবাজার বায়ু বিদ্যুৎ কারখানার দুটি প্রধান সরঞ্জাম বাংলাদেশের চট্টগ্রামে পৌঁছেছে। এটা কক্সবাজারের এ প্রকল্পের জন্য মাইলফলক, যার মানে চলতি বছরের শেষ দিকে চালু হওয়ার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলা।
জানা গেছে, সে প্রকল্প চালু হওয়ার পর বার্ষিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ হবে ১৪ কোটি ৫৬ লাখ কিলোওয়াট। বর্তমানে জ্বালানির অভাবে অস্থায়ী লোডশেডিং-এ ভুগছে বাংলাদেশ। ফলে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সুখবর।
বাংলাদেশের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে সহযোগিতা চালানোর পর এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে আবার চীনের সঙ্গে সহযোগিতা করছে ঢাকা। তাতে চীনের কাঠামোগত প্রতিষ্ঠার ক্ষমতার প্রতি বাংলাদেশের স্বীকৃতির পাশাপাশি নতুন জ্বালানি উন্নয়নে দু’দেশের অভিন্ন চেতনার প্রতিফলন হয়েছে।
অদূরে কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ সরকার ৫টি পুনঃব্যবহারযোগ্য জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দুটি বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানা এবং ৩টি সৌরবিদ্যুত্ কারখানা। সে সব প্রকল্পের অনেকটাই চীনা কোম্পানি দিয়ে নির্মিত হবে। তাতে দেখা যায় যে, চীন ও বাংলাদেশ নতুন জ্বালানি উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণে সহযোগিতার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
নতুন জ্বালানি উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে অভিন্ন সচেতনতা। ২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পি ৭৫তম জাতিসংঘ সম্মেলনের সাধারণ বিতর্কে বলেছেন, চীন তার অবদানের পরিমাণ উন্নত এবং আরও শক্তিশালী নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যাতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ ২০৩০ সালে শীর্ষে পৌঁছাবে এবং ২০৬০ সালের মধ্যে নিরপেক্ষতা বাস্তবায়ন করা যাবে। অন্যদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নয়, বরং চীন ইতিবাচকভাবে দুটি লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
গত বছর মাত্র উন্নয়নশীল দেশের সারিতে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত কপ-২৬ শীর্ষসম্মেলনে বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তনের কাঠামোগত চুক্তি কর্তৃপক্ষের কাছে জাতীয় নির্ধারিত অবদান পরিকল্পনা উত্থাপন করেছে। তাতে আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে তৈরি হবে বলে আশা ব্যক্ত করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ দুর্বল দেশগুলোর অন্যতম। যদিও দেশটির কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ বিশ্বের মোট পরিমাণের ০.৪৭ শতাংশের চেয়ে কম। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছে। গত সাত বছরে জলবায়ু মোকাবিলার ক্ষেত্রে ব্যয় দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার বায়ু বিদ্যুৎ তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করছে। ২০২৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে তৈরি বিদ্যুতের পরিমাণ জাতীয় বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ১০ শতাংশ উন্নত করার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উদ্যোক্তা সংস্থা এনার্জি ট্র্যাকার এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭২৪ কিলোমিটার উপকূলীয় অঞ্চলে বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উপযোগী। কক্সবাজারের সে প্রকল্প চালু হওয়ার পর প্রতিবছর ৪৪ হাজার ৬শ টন কয়লা সাশ্রয় হবে এবং ১ লাখ ৯ হাজার দু’শ টন কম কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন হবে। যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জ্বালানি সাশ্রয় ও নির্গমন কমানো এবং পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।
চীনের বায়ু বিদ্যুৎ প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন হয়েছে। আগেকার বিদেশি প্রযুক্তি গ্রহণ থেকে উন্নতি করে বর্তমানে চীনের বায়ু বিদ্যুৎ প্রযুক্তি বিশ্বের প্রথম সারিতে রয়েছে। কক্সবাজারের প্রকল্পের চীনা গ্রুপ এসপিআইসির বর্তমানে পিভি ইন্সটল ক্ষমতা ৩ কোটি ৫০ লাখ কিলোওয়াট ছাড়িয়েছে। নতুন জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৭ কোটি কিলোওয়াট এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ১০ কোটি কিলোওয়াট ছাড়িয়েছে। এ তিনটি সূচক বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে। কক্সবাজারের সে প্রকল্পের পর গ্রুপটি বাংলাদেশের সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নে আরও সহযোগিতা চালাবে।
গত বছরের কপ-২৬ শীর্ষসম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নত দেশগুলোকে বহনযোগ্য খরচে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উন্নয়নে সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চীন বরাবরই মানব জাতির অভিন্ন স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কমিউনিটি গঠনের চেতনায় পরিবেশবান্ধব জ্বালানির বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের স্বার্থ রক্ষা করে আসছে। চীন ও বাংলাদেশ উভয় ব্যাপক জনসংখ্যার দেশ। নিজ দেশের জনগণের স্বার্থ এবং মানব জাতির অভিন্ন স্বার্থে ভবিষ্যতে দু’দেশ অবশ্যই নতুন জ্বালানিসহ নানা সহযোগিতা চালিয়ে বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণে আরও অবদান রাখবে।
(রুবি/এনাম)