গত ২৭ জুলাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো- বিবিএস জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২’র প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এটি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ষষ্ঠ জনশুমারি।
বিবিএসের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৩ জন। এর আগে ২০১১ সালের জনশুমারিতে জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৭ জন। অর্থাৎ গত ১১ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ২ কোটি ১১ লাখ ১৪ হাজার ৯১৯ জন। শতকরা হিসেবে জনসংখ্যা বেড়েছে ১৪.৬৫ ভাগ।
এবারে জনশুমারিতে কিছু লক্ষণীয় বিষয়ের অন্যতম- প্রথমবারের মতো পুরুষদের ছাড়িয়েছে নারীর সংখ্যা। সে হিসেবে এবার নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন। আর পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন। অর্থাৎ ১০০ জন নারীর বিপরীতে এখন বাংলাদেশে পুরুষের সংখ্যা ৯৮ জন। মোট জনসংখ্যার ৪ কোটি ৫৯ লাখ বা এক চতুর্থাংশই তরুণ।
সার্বিকভাবে কমেছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার। ২০১১ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যেখানে ১.৩৭ শতাংশ সেখানে ২০২২ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ১.২২ শতাংশে। সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ। মুঠোফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫৫.৯৮ শতাংশ আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩০.৬৮ শতাংশ।
জনশুমারির আরও কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য হচ্ছে- গত একদশকে দেশে হিন্দু জনগোষ্ঠির সংখ্যা বাড়লেও আনুপাতিক হারে কমেছে। এখন দেশের মোট জনসংখ্যার ৭.৯৫ শতাংশ হিন্দু। ২০১১ সালে তা ছিল ৮.৫৪ শতাংশ। অন্যদিকে মুসলিম জনসংখ্যা ও আনুপাতিক হার দুটোই বেড়েছে। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যার ৯১.৪ শতাংশ মুসলিম। ২০১১ সালে তা ছিল ৯০.৩৯ শতাংশ।
বলা হচ্ছে দেশত্যাগ ও প্রজনন হার তুলনামূলক কম হওয়ায় হিন্দুদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে কমেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী এবার বৌদ্ধ ও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের আনুপাতিক হারও কমেছে। ২০১১ সালে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল শূণ্য দশমিক ৬২ শতাংশ। এবার তা কমে দাঁড়িয়েছে শূণ্য দশমিক ৬১ শতাংশে। আর খ্রিস্ট ধর্মবলম্বীদের সংখ্যা শূন্য দশমিক ৩১ শতাংশ থেকে কমে এবার দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশে।
জনশুমারিতে ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনসংখ্যা হয়েছে সাড়ে ১৬ লাখে কিছু বেশি। জনসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী চাকমা। আর প্রথমবারের মতো জনশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রথম জনশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে। এবার ষষ্ঠ জনশুমারিটি হয়েছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। আশা করা হয়েছিল যে ডিজিটাল হওয়ায় এবার দ্রুত, নির্ভুল তথ্য পাওয়া যাবে। তবে, দ্রুত তথ্য মিললেও তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে।
সাধারণত জনশুমারি হয়ে থাকে শীতকালে- যাতে করে বাড়িবাড়ি গিয়ে গণনাকারীর ভালোভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু এবার তা হয়েছে বর্ষাকালে। ট্যাব কেনার জটিলতায় জনশুমারির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ অসময়ে করতে হয়েছে। ওই সময়টাতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুড়িগ্রামসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা ছিল। এ জন্য শুমারির কার্যক্রম ২৮ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু এটা একরকম চোখ বন্ধ করে বলা যায়-গণনাকারীরা সব জায়গায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি বা করেননি। খোদ রাজধানী ঢাকাতেও বহু বাসায় গণনাকারীরা জাননি বলে তথ্য পাওয়া গেছে। অনেক জায়গায় বাড়ির দারোয়ান, ড্রাইভারের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে দায়সারাভাবে কাজ সেরেছেন তারা। প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেশের যে জনসংখ্যার কথা বলা হয়েছে কিংবা খোদ রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা বিশ্বাসযোগ্য নয়- বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়টা এবারের জনশুমারিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কারণ জনশুমারি যে কোনো দেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। চাল-ডাল, তেল-নুন থেকে শুরু করে দেশের আমদানি-রপ্তানি, সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে এ তথ্যে যদি বড় গরমিল থাকে তাহলে তা সংশ্লিষ্ট দেশের সার্বিক পরিচালনায় বড় বিঘ্ন তৈরি করে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনোমতেই জনশুমারির জন্য বর্ষাকালকে বেছে নেওয়া ঠিক হয়নি। আর গণনাকারীরা যথাযথভাবে তথ্য সংগ্রহ করেছেন কি-না সে বিষয়েও পর্যাপ্ত তদারকরির ঘাটতি ছিল। আর সংগৃহীত তথ্য যথাযথভাবে সার্ভারে পৌঁছেছে কি-না এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
তবে জনশুমারিকে এখনো যথাসম্ভব নির্ভুল করার সুযোগ রয়েছে। জনশুমারির কাজটি পাঁচটি ধাপে করা হয়ে থাকে। এর দ্বিতীয় ধাপটি হচ্ছে মূল শুমারি বা প্রশিক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহ। দ্বিতীয় ধাপের পরই প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এর পর তৃতীয় ধাপে শুমারি পরবর্তী যাচাই বা পিইসি’র কাজ করা হয়। জাতিসংঘ নীতিমালা অনুযায়ী নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পিইসির কাজটি করতে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একাজটি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে সরকারকে। তাহলে জনশুমারির ভুল-ভ্রান্তি কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা যাবে।
আশার কথা প্রতিবেদন প্রকাশের দিনই সরকারের তরফে বলা হয়েছে, তারা জনশুমারির পরবর্তী ধাপগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করে একটি যথাসম্ভব নির্ভুল প্রতিবেদন দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।