চীনা ওয়াল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার কু ইং
2022-07-30 15:23:57

কু ইং,একজন চীনা ওয়াল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার। ২০১৬ সালে তিনি কাছাকাছি পরিসরে তিব্বতি বাদামি ভাল্লুকের ছবি তোলার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে স্থির হয়ে বসেছিলেন। তাদের  মধ্যে দূরত্ব ছিল মাত্র ৮ মিটার, অবশেষে তিনি দারুণ কিছু ছবি তোলেন। কিন্তু তাকে বাদামি ভালুকও দেখে ফেলে এবং ভাল্লুকের আক্রমণে তিনি প্রায় ধরাই পড়ে গিয়েছিলেন।

ছিংহাই-তিব্বত মালভূমি, যার গড় উচ্চতা চার হাজার মিটার, সেখানে কু ইং গত চার বছর ধরে বাস করছেন ও কাজ করছেন। সেখানকার বন্যপ্রাণী এবং তাঁর নানা গল্প রয়েছে।

 

এর আগে কু ইং জাতীয় প্যারাগ্লাইডিং দলের সদস্য ছিলেন এবং চারটি জাতীয় মহিলা প্যারাগ্লাইডিং চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করেছেন।

তিনি বলেছিলেন যে, নীল আকাশের প্রতি তার সহজাত ভালবাসা রয়েছে। তার মতে নীল আকাশ স্বাধীনতার প্রতীক। যাইহোক, ভাগ্য অকালে কু ইংকে তার নীল আকাশে ওড়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল।

২০০৯ সালে প্যারাগ্লাইডার জাতীয় দল যখন বিশ্বকাপের প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন কু ইং ঘটনাক্রমে গতি হারিয়ে আকাশ থেকে পড়ে যান, যার ফলে দ্বিতীয় কটিদেশীয় কশেরুকায় ফ্র্যাকচার হয়। ডাক্তার কু ইংকে বলেছিলেন যে, তাকে অন্তত দুই বছর বিশ্রাম নিতে হবে, তা না হলে জটিল সমস্যা হতে পারে।

ভাগ্য কু ইংয়ের উড়ন্ত ডানা ভেঙ্গে দেয়, কিন্তু তার সামনে আরেকটি সম্ভাবনা তুলে ধরে।

নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য কু ইং বিছানা থেকে উঠার পর পরই ফটোগ্রাফি শিল্পে একদল বন্ধুর সাথে ছবি তুলতে ঘুরে বেড়ানো শুরু করেন। তিনি তার বন্ধুর সরঞ্জাম ব্যবহার করেছিলেন কালো মুখের স্পুনবিলের ছবি তোলার জন্য। যখন তিনি কালো মুখের স্পুনবিলের পাখা খুলে ফেলতে দেখেছিলেন, তখন কু ইং অনুভব করেন যে, তার হৃদয় পাখির সাথে নীল আকাশে ফিরে এসেছে। অর্থাৎ, সেই দিন থেকে, কু ইং ভারি ক্যামেরা ব্যাগ নিয়ে পাখি ও বন্য প্রাণীর ছবি তোলাকে উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারণ করা শুরু করেন।

 

বন্য প্রাণীর প্রতি কু ইং-এর অসাধারণ ভালোবাসা রয়েছে। দৈবক্রমে কু ইং মেরু ভালুক নিয়ে একটি তথ্যচিত্র দেখেন, তাই তিনি মেরু ভালুকের জন্ম দেওয়ার ছবি ধারণ করতে চান। পরে তিনি ‘এমপেরর পেঙ্গুইনের’ প্রজননের ছবি তুলতে অ্যান্টার্কটিকায় যান। এভাবে, বন্য প্রাণীদের ছবি তোলার জন্য কু ইং কয়েক ডজন দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি বলেন, তার কাজের মাধ্যমে, তিনি এই বিরল প্রাণীদের বসবাসের পরিবেশ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করবেন এবং প্রকৃতির প্রতি মানুষের মুগ্ধতা জাগ্রত করবেন।

 

গভীর মানবতাবাদী উদ্বেগযুক্ত কু ইংয়ের শিল্পকর্ম দ্রুত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং তার ছবিগুলো একের পর এক পুরষ্কার জিতেছে।

অ্যান্টার্কটিক এবং উত্তর মেরুতে ছবি তোলার পর কু ইং ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে ছবি তোলার ধারণা সৃষ্টি করেন।

ছিংহাই-তিব্বত মালভূমি, যা পৃথিবীর তৃতীয় মেরু হিসেবে পরিচিত, এখনও পৃথিবীর সবচে আদিম প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ধরে রেখেছে এবং বন্য প্রাণীদের কেন্দ্রীভূত এলাকাগুলোর মধ্যে একটি।

কু ইং বলেছেন, বন্য প্রাণীদের শুটিংয়ের বিষয়টি সেই সময় খুব কমই সম্পন্ন হয়েছিল। এটি আমার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ও প্রলোভন ছিল।

২০১৬ সালে কু ইং তিব্বতি গজেলের ছবি তুলতে ইয়াংজি নদী, হলুদ নদী ও লানছাং নদীর উত্স এলাকায় যান। প্রাকৃতিক পরিবেশের নানা বিপদের পাশাপাশি বন্য প্রাণীদের আক্রমণও কু ইংয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

একবার তাঁবুর খাবারের গন্ধ একটি বাদামী ভালুককে টেনে আনে। বাদামী ভালুকটি তাঁবুর বাইরে দশ দিনের বেশি সময় ধরে ঘুরে বেড়ায়। কু ইং এতটাই ভয় পেয়েছিলেন যে, তিনি তাঁবু থেকে বের হবার সাহস পাননি। তিনি কেবল প্রতিবেলা পোরিজ খেতেন। টয়লেটে যাওয়া পরিমাণ কমাতে তিনি পানি পান করা বন্ধ করে দেন।

 

আরেকবার যখন কু ইং মনোযোগ দিয়ে তিব্বতি হরিণগুলোকে ছবি তুলছিলেন, তখন তিনি হঠাৎ দেখেন যে, সব তিব্বতি হরিণ পালিয়ে গেছে। কু ইং চারদিকে তাকান। দেখেন বাদামী ভালুক তার দিকে ছুটে আসছে। কু ইং চমকে ওঠেন। তিনি দ্রুত ছুটে যান গাড়ির দিকে। হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যান। বাদামী ভালুকটি তার থেকে মাত্র আট বা নয় মিটার দূরে ছিল। সৌভাগ্যক্রমে কু ইং ও ভাল্লুকের মধ্যে একটি বাধা ছিল। সেই বাধা বাদামী ভালুককে থামিয়ে দেয় এবং কু ইং সেই সুযোগে গাড়িতে উঠে যান।

 

হোহশিল-এর বন্য সৌন্দর্য কু ইংয়ের কাছে দুর্দান্ত মনে হয়। কু ইং বলেন যে, যদিও তিনি কয়েক ডজন দেশ এবং চীনের বেশিরভাগ প্রকৃতি সংরক্ষণ এলাকায় গিয়েছেন, এসব জায়গা আকর্ষণীয় হলেও তাকে ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু তিনি হোহশিলে আসার পর, আর সেই স্থানটি ছেড়ে যাননি এবং এই জায়গা ভালোবেসে ফেলেছেন। সানচিয়াংইউয়েন অথবা ইয়াংজি নদী, হলুদ নদী ও লানছাং নদীর উত্স এলাকা যেন তার আত্মার পরিচিত স্থান এবং তিনি এখানে তার বাকি জীবন থাকতে চান।

কু ইংয় মনে করেন- অনেক ফটোগ্রাফার আছেন, যারা সানচিয়াংইউয়েন ছবি তোলেন। কিন্তু খুব কম লোকই এখানে ছবি সংগ্রহের জন্য দীর্ঘসময় অবস্থান করেন। তিনি বলেন যে, আপনি যদি দীর্ঘমেয়াদে এখানে না থাকেন, চিত্রগ্রহণের জন্য প্রচুর সময় ও শক্তি ব্যয় না করেন, আপনি অবশ্যই ভালো ছবি পাবেন না। সানচিয়াংইউয়ানে বন্যপ্রাণীদের চিত্রগ্রহণ করতে চাইলে আপনার প্রকৃত পেশাদার জ্ঞান এবং পেশাদারী মনোভাব প্রয়োজন। আপনি দ্রুত সাফল্যের জন্য তাড়াহুড়া করে ছবি তুললে ভালো কিছু পাবেন না।

 

২০১৬ সালে কু ইং ১৬তম চীনের পিংইয়াও আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফি প্রদর্শনীর গ্র্যান্ড প্রাইজ অথবা শ্রেষ্ঠ ফটোগ্রাফার পুরস্কার জিতেন। সানচিয়াংইউয়েনের বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত কু ইংয়ের শিল্পকর্মগুলো আরও বেশি সংখ্যক লোকের সঙ্গে  পরিচিত হয় এবং তাদের সমাদর পেয়েছে। নানা সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইটে তার সম্পর্কে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

ছিংহাই-তিব্বত মালভূমি ‘বিশ্বের ছাদ’ হিসাবে পরিচিত, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮০০০ মিটার উপরে প্রায় সব চূড়া রয়েছে। এখানে ১০৪৭ প্রজাতির স্থলজ মেরুদণ্ডী প্রাণী রয়েছে, যা চীনের প্রাণীর মোট সংখ্যার ৪৩.৭ শতাংশ। সেগুলোর মধ্যে বিপন্ন এবং হুমকির মুখে ৯৫টি স্থলজ মেরুদণ্ডী প্রাণীর প্রজাতিও রয়েছে।

মালভূমিতে বসবাসকারী বন্য প্রাণীদের অন্যান্য আঞ্চলিক প্রাণীদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্য এবং জীবনযাপনের অভ্যাস রয়েছে। কু ইং কাছাকাছি থেকে পর্যবেক্ষণ এবং রেকর্ড করতে পেরে ভীষণ উত্তেজিত ছিলেন। যাইহোক, এই উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ ‘উচ্চতার অসুস্থতা’ তার ধারণার বাইরে চলে যায়।

 

‘আমি সেখানে মাত্র এক বা দুই বছর ছিলাম এবং উচ্চতার প্রভাব বেশ গুরুতর ছিল। আমি সেখানে গেলে প্রতিবার বমি করতাম। পর দিন আমি প্রথম দিনে যা খেয়েছিলাম- সবই বের হয়ে যেতো। এরপর, তৃতীয় দিন আমি খালি পেটে থাকতাম। তারপর কেবল চতুর্থ দিনই ধীরে ধীরে খাবার খেতে পারতাম। এই নিয়মটি বের করার পর- যতবার তিনি হোহ শিল-এ যেতেন, ততবার খালি পেটে থাকতেন বা কম খাবার খেতেন। তার জন্য, উচ্চতার অসুস্থতা বা অন্যান্য বাধা, শুটিংয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।

 

তিব্বতি হরিণ প্রতি বছর জুন মাসে বাচ্চা দেয়। শুটিং মৌসুমে কু ইং ঝাঁকে ঝাঁকে হরিণদের জড়ো হওয়ার জায়গায় আগে থেকেই আশেপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে একই রঙের তাঁবু স্থাপন করেন।

এ ছাড়া, তিনি খুব বেশি শব্দ করেন না, মন চাইলেই হাঁটাহাঁটি করেন না এবং খুব বেশি গন্ধ হয় এমন খাবার খান না।

রাত না হওয়া পর্যন্ত এবং তিব্বতি হরিণ উপত্যকা ছেড়ে না-যাওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁবু থেকে তার বাসায় ফিরেন না। তিনি প্রায় এক মাস এভাবেই জীবন কাটিয়েছেন।

“আপনি যদি এই তিব্বতি হরিণগুলোকে ভালোভাবে ছবি তুলতে চান, তাহলে আপনাকে প্রথমে ভেড়ায় পরিণত হতে হবে।” কু ইং এভাবেই বলেন।

 

গত ছয় বছর ধরে, কু ইং এই নিয়ম মেনে চলেছেন। এমন কঠোর পরিবেশে শুটিংও তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে, যেমন, নেকড়ের দল তিব্বতি অ্যান্টিলোপকে আক্রমণ করে। আক্রমণটি দ্রুত শেষ হয়। তাই ফটোগ্রাফারের ক্যামেরার লেন্সটিও একটি চটপটে নেকড়ে বা চিতাবাঘের মতো দ্রুত হতে হবে, একটি ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তে এটি ক্যাপচার করতে হবে। সবচে মূল্যবান মুহূর্তটি যদি মিস করেন, তাহলে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হবে।