চীনের খাবার দাবার নিয়ে আমাদের দেশে নানা কথা প্রচলিত। প্রতিবারই চীনে আসলে পরিচিত জনরা জিজ্ঞেস করে কি খাচ্ছি, খেতে পারছি কিনা ইত্যাদি। খাবার দাবার নিয়ে আমার কখনো তেমন কোন সমস্যা হয় না। আমি শুধু বলে দেই হালাল ফুড দিতে। সাথে ফলমূল।
চীনের প্রায় সব শহরে মুসলিম রেস্টুরেন্ট আছে। এসব রেস্টুরেন্টে সব হালাল ফুড। এমনকি চীনাদের বললেও ওরা ব্যবস্থা করে দেন। চীনাদের খাবারে যারা শুধু পোকামাকড় খোঁজে তাদের জানা দরকার এ দেশে বিভিন্ন পদের মাছ, গরু, হাঁস, মুরগী, পাখির মাংস সমান জনপ্রিয়। বেইজিং ডাকের কথা তো সর্বজন বিদিত। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও বেইজিং ডাক অর্থাৎ বেইজিংয়ের হাঁসের মাংসের সুনাম রয়েছে।
তবে চীনাদের সাথে আমাদের খাদ্যাভাসের পার্থক্য রয়েছে সেটা অস্বীকার করা যায় না। যেমন চীনারা অর্ধসেদ্ধ শাকসব্জি খেতে পছন্দ করে। খাবার গ্রহনের সময়েও আমাদের সাথে তাদের পার্থক্য বিদ্যমান। চীনারা সকাল ছয়টা সাতটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট, দুপুর বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে লাঞ্চ এবং বিকেল সাড়ে পাঁচটা ছয়টার মধ্যে ডিনার খান। এটা আমাদের দেশে অসম্ভব ব্যাপার। চীনে আসলে প্রথম কয়েকদিন এই বিষয়েই সতর্ক থাকতে হয়। নইলে অসুস্থ হয়ে পরার সম্ভাবনা থাকে। যেমন কুনমিংয়ে কোয়ারেন্টাইনের দ্বিতীয় দিন রাতে আমার এরকম সমস্যা হয়েছিল। মাঝরাতের দিকে হঠাৎ করে গ্যাস ফর্ম করে। সময় গড়াতে গ্যাসের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। না বসে থাকতে না শুতে পারছি এরকম অবস্থা। গ্যাস্ট্রিকের তীব্রতায় পেটের ওপরের অংশে ও বুকের মাঝ বরাবর তীব্র ব্যাথা হতে লাগলো। উপশমের জন্য সঙ্গে করে নিয়ে আসা গ্যাসের ওষুধ খেলাম। তাতেও কাজ হয় না। অনেক কষ্ট করে রাত পার করলাম। ভোরের দিকে রুবি (ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস কর্মকর্তা, সেও হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে) এবং মার্ক ওয়াংকে ব্যাপারটা জানালাম। মার্ক ওয়াং চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় কর্মকর্তা। বাইরে থেকে সেই আমার দেখভাল করে। কি ধরনের সমস্যা হচ্ছে সে ব্যাপারে ইন্টারকমে রুবি আমার কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নিলেন। কারণ যে ডাক্তার আসবে তিনি আবার ইংরেজি জানেন না। আমার পক্ষে রুবি তাকে সব বলবেন।
সকাল সাতটা নাগাদ আপাদমস্তক পিপিইতে ঢাকা ডাক্তার সাহেব আসলেন। পেটে হাত দিয়ে হাল্কা টেপাটেপি করলেন, স্বয়ংক্রিয় মেশিন দিয়ে হৃদকম্প স্বাভাবিক আছে কিনা সব কিছু পরীক্ষা করলেন। হজমের কারণেই হোক আর দেশ থেকে আনা গ্যাস্ট্রিক নিরোধী ওষুধের কারণেই হোক ততক্ষণে গ্যাসের তীব্রতা কিছুটা কমে গেছে। সবকিছু দেখেশুনে চৈনিক চিকিৎসক মহাশয় ইশারা ইঙ্গিতে এবং হাতে কলমে কিছু ব্যায়াম এবং মেসেজ দেখিয়ে দিলেন। এগুলো আমাকে করতে হবে। তন্মধ্যে একটা হল পেটে হাত দিয়ে ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘোড়ে সেদিকে দুইশ’ বার এবং উল্টোদিকে দুইশ’ বার মেসেজ করতে হবে। এক্সারসাইজের পাশাপাশি হাঁটুর নিচে একটা রগ দেখিয়ে সেটা মেসেজ করার ফরমায়েশ দিলেন। কিন্তু কোন ওষুধ দিলেন না। আমি যতবার তাকে ইশারা ইঙ্গিতে বোঝাতে চাই ওষুধের কথা ততবার সেটা এড়িয়ে যেতে লাগলেন তিনি। শেষতক রুবিকে ফোনে বলে ডাক্তারকে ধরিয়ে দিলাম। পরে রুবি আমাকে জানালেন ডাক্তার বলেছেন ওষুধ লাগবে না। আমার তো প্রচন্ড মেজাজ খারাপ। এরকম গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আমার গোটা জীবনে হয়নি। আর ব্যাটা বলে কি ওষুধ লাগবে না। তার দেখানো এক্সারসাইজই যথেষ্ট। ডাক্তার চলে গেলেন। মেজাজ খারাপ নিয়ে বসে রইলাম। শেষে রুবিকে ফোন করে বললাম আমার আবারও এরকম সমস্যা হতে পারে। দ্রুত ব্যবস্থা হিসেবে ডাক্তারকে আপাতত কিছু ওষুধ দিতে বলেন। শেষে বিকেলে দেখি দু’পাতা ওষুধ পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাও এলোপ্যাথিক কোন ওষুধ নয়, চীনের ট্র্যাডিশনাল ওষুধ। বড়িগুলো অনেক বড় বড়। দিনে একটা করে খেতে হবে, তিন দিন। চিবিয়ে খেতে হবে। তিন দিন মাত্র তিনটা বড়ি খেলাম। স্বাদটা হালুয়ার মত। তাতেই গ্যাস্ট্রিক সমস্যা দুর হয়ে গেল। গ্যাস্ট্রিক সমস্যা তো দুর হলই সাথে ক্ষুধার তীব্রতাও আগের চেয়ে গেল বেড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে রুবি অবশ্য হোটেলের খাবারের পাশাপাশি কেক, নুডলস, ব্রেড, বাদামসহ বাইরের আরও কিছু খাবার পাঠিয়ে দেন। হজম, গ্যাস্ট্রিক উপশমের জন্য বড়িটা খুব কার্যকরী মনে হয়েছে। ওষুধটির নাম বাওহে ওয়ান। একেবারে জাদুকরী এক চৈনিক পথ্য।
ঠিক একই সমস্যার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোন চিকিৎসকের কথা চিন্তা করুন। সবাই না হলেও অন্তত বেশিরভাগ বাংলাদেশি চিকিৎসক এ ক্ষেত্রে কি করতেন। এটা সেটা পরীক্ষা তো দিতেনই সেইসাথে একগাদা গ্যাস্ট্রিক নিরোধী ওষুধ সম্বলিত প্রেসক্রিপশন একটা ধরায়ে দিতেন। অথচ চীনা চিকিৎসক এত সহজে কোন ওষুধ দিতে চান নাই। আমার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত একটা ওষুধ দিলেও তা নানাবিধ সাইডইফেক্ট সম্বলিত এলোপ্যাথিক কোন ওষুধ নয়। একেবারে তাদের ট্র্যাডিশনাল ওষুধ যার তেমন সাইডইফেক্ট নাই বললেই চলে। এ কারণেই দেশের সামর্থ্যবানরা চিকিৎসার জন্য বাইরে চলে যান। কিন্তু সাধারণ মানুষকে দেশেই চিকিৎসা নিতে হয়। শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত ও পরিবর্তন করলেই চলবে না সেইসাথে চিকিৎসকদের মানসিকতায়ও আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই হয়তো সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে।
লেখক: ইমরুল কায়েস