গত মার্চে সরকারের শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেওয়ার চার মাস না পেরুতেই মারাত্মক বিদ্যুৎ সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। আর ঘাটতি মেটাতে রাজধানীসহ সারাদেশে চলছে ‘পরিকল্পিত’ লোডশেডিং। প্রচণ্ড গরমে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন দেশের মানুষ। ব্যাহত হচ্ছে শিল্প উৎপাদন। কৃষিতে সেচ দিতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষাবাদ।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। তবে ব্যবহার মাত্র ১২-১৩ হাজার মেগাওয়াট। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশকি মুদ্রা সাশ্রয়ে সরকার ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়। একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে এলএনজির অস্বাভাবিক মূল্য বাড়ায় গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও উৎপাদন কমেছে।
গত শুক্রবার সারাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৭৯৪ মেগাওয়াট। শনিবারও কাছাকাছি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এদিন লোডশেডিং ছিল ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের মতো।
বিদ্যুতের এ ঘাটতি মেটাতে ৪ জুলাই থেকে পরিকল্পিত লোডশেডিং করা হচ্ছে। রাজধানীসহ ঢাকা বিভাগ, রংপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীর শহর-গ্রাম সর্বত্রই চলছে পরিকল্পিত এ লোডশেডিং। কিন্তু এক ঘন্টার লোডশেডিং শহরাঞ্চলে দু’তিন ঘন্টা আর গ্রামাঞ্চলে ৮-৯ঘন্টায় গিয়ে দাঁড়ালে তাকে আর যাই বলা যাক পরিকল্পিত বলা মুশকিল।
কঠিন এ পরিস্থিতি থেকে সহসা মুক্তি মিলবে এমন কোনো ভরসাও করা যাচ্ছে না। গত ৭ জুলাই বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে একটি সভা হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী জানান আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লোডশেডিং চলবে। তিনি জানান, কয়লাভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রামপাল, আদানি ও পায়রার দ্বিতীয় ইউনিট চালু হলে ৩২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এতে বিদ্যুৎ সংকট কেটে যাবে।
এখানে বেশ কিছু কিন্তু রয়েছে।
প্রথমত: বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালু নভেম্বরের আগে করা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত: রামপাল আর পায়রার দ্বিতীয় ইউনিট চালু হলেও সেখান থেকে ঢাকায় বিদ্যুৎ আনার সঞ্চালন লাইনই এখনো তৈরি হয়নি। ডিসেম্বর নাগাদ তা শেষ করা চেষ্টা চলছে।
তৃতীয়ত: ভারতের ঝাড়খণ্ডের আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আনার সঞ্চালন লাইনও এখনো তৈরি হয়নি। আর ডিসেম্বরের আগে তা হবার সম্ভাবনা নেই।
আরেকটি কথা বিশ্ববাজারে জ্বালানি আর এলএনজির দাম বাড়লে কয়লার দামও তো বাড়তে পারে। তাই কয়লা সরবরাহ কতটা নির্বিঘ্ন থাকবে সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে না সেপ্টেম্বরের পর দেশে বিদ্যুৎ সংকটের সুরাহা হবে। তবে জুলাই-আগস্টে শ্রাবণের বৃষ্টি আর অক্টোবর থেকে শীতের আগমনে বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমবে। এ হিসেবে লোডশেডিং কমতে পারে অক্টোবর থেকে। সে ক্ষেত্রে মার্চে গিয়ে আবার গরম শুরু হলে বোঝা যাবে বিদ্যুৎ সংকট আসলে কতটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি আমরা। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন- আগামী মার্চে বিদ্যুৎ নিয়ে বাংলাদেশ আরও বড় সংকটে পড়তে পারে।
তারা বলছেন, করোনা মহামারি কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগেও প্রকৃতপক্ষে দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি খুব একটা ভালো ছিল না। শতভাগ বিদ্যুতায়নকে কেউ কেউ জোর করে তৈরি করা একটা বিষয় হিসেবে দেখছেন। উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে শতভাগ প্রস্তুত হতে পারলেই কেবল শতভাগ বিদ্যুতায়ন সফল হতে পারে। কিন্তু এ তিনটি ক্ষেত্রেই আমাদের ঘাটতি রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানির কথা মাথায় না রেখেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানানো হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ৫৫ ভাগ বিদ্যুৎ এখন বাসাবাড়ি আর গৃহস্থালির কাজে চলে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত বিদ্যুতায়নের কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে দেশে যে ৬৫ লাখ সোলার হোমসিস্টেম ছিল সেগুলোর অর্ধেক এখন পরিত্যক্ত। সরকার ভাবমূর্তি রক্ষায় ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র সচল রেখে অনেক বেশি ব্যয় করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে- যা কাম্য ছিল না।
সর্বোপরী জ্বালানি খাতে আমাদের কোনো নীতি বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই। মন্ত্রণালয়, পোট্রোবাংলা, পিডিবিতে ভাল সমন্বয় নেই। সবকিছুই চলছে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের নিরিখে। এ সবকিছুই বিদ্যুৎ খাত নিয়ে আমাদের একটা বড় বিপদে ফেলে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় সরকারকে আরও আগে সাশ্রয়ী নীতি ও লোডশেডিংয়ে যাওয়া উচিত ছিল। দেরিতে হলেও সরকার সঠিক পথে গেছে। এখন এ উদ্যোগ আরও জোরদার করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি ও জনগণকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সম্পৃক্ত করতে হবে। সরকারি পর্যায়ে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সাশ্রয়ের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ তাদের। আর শিল্প কারখানার বদলে গৃহস্থালীতে অধিক সাশ্রয়ের কথা বলছেন তারা।
দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি নিরাপত্তা গড়ে তুলতে গভীর বঙ্গোপসাগারে গ্যাস অনুসন্ধানের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। সর্বোপরী একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নীতি প্রণয়ন দরকার বলে অভিমত তাদের।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, সিএমজি বাংলা।