জিপলাইন মেয়ের গল্প
2022-07-15 19:20:24

গত মাসে চীনের সংখ্যালঘু জাতি লিসু জাতির ২৩ বছর বয়সী মেয়ে ইয়ু ইয়ান ছিয়া চীনের ইয়ুননান প্রদেশের রাজধানী খুনমিং শহরের এক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেন। অনেক বছর কঠোর লেখাপড়ার পর অবশেষে বড় শহরে থাকার সুযোগ পান। তবে তিনি একটি ভিন্নধর্মী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জন্মস্থানের গ্রামে ফিরে যাবেন, স্থানীয় হাসপাতালের একজন চিকিত্সাকর্মী হিসেবে কাজ করবেন, স্থানীয় গ্রামবাসীদের সেবা দেবেন।

 

তরুণী ইয়ু’র বাসা ইয়ুননান প্রদেশের নু চিয়াং রাজ্যের মা জি গ্রামের বু সি দি দলে। চলুন ফিরে তাকাই ২০০৭ সালে। তখন গ্রামের লোকজন দরজার সামনের বড় বড় নু চিয়াং নদী পার হতে চাইলে জিপলাইন বা কেবল কারের ওপর নির্ভর করে পার হতো। তখন মেয়ে ইয়ু নদীর ওই পাশের স্কুলে লেখাপড়া করতে যেতো, তার প্রতিটি দিন ছিল এমনই ঝুঁকিপূর্ণ! তখন এভাবেই  নদী পার হতে হতো।

এক দিন ইয়ু গায়ে লাল কাপড় পরে কাঁধে স্কুলব্যাগ নিয়ে, একাই নু চিয়াং নদীর ওই তীরের প্রাথমিক স্কুলে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনিই সাংবাদিকের ক্যামেরায় জিপলাইনের মাধ্যমে বড় নদী পার হওয়ার সেই দৃশ্য ধরা পড়ে।

তখন ইয়ু’র বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। প্রতিদিন সে দুইবার জিপলাইন দিয়ে নদী পারাপার হতো। আর তখন ছিল জিপলাইনে নদী পার হওয়ার দ্বিতীয় বছর।

ইয়ু তখনকার কথা স্মরণ করে বলেন: কানের পাশে হু হু বাতাস বইতো, নিচ দিয়ে গর্জন করে ছুটে যেত নদীর পানি। আর তাতে বুকের ভেতর কাঁপুনি তৈরি হতো।

তখন ছোট ইয়ু’র প্রতিদিন একাই জিপলাইনের মাধ্যমে বড় নদী পার হওয়ার দৃশ্য দেখে সাংবাদিকরা মুগ্ধ হন। এরপর তাঁরা দেশের বেশ কিছু সংবাদসংস্থার সঙ্গে একটি অর্থ সংগ্রহ কর্মসূচির আয়োজন করেন। এর মাধ্যমে নদীতে একটি ভালোবাসার সেতু তৈরি করা হয়।

২০০৮ সালের মার্চ মাসে ভালোবাসার সেতু তৈরি হয়। তখন ইয়ু ছিল সেই সেতু দিয়ে নদী পার হওয়া প্রথম মানুষ।

জীবনে তখনই প্রথমবারের মতো সেতু দেখেছিল ইয়ু। মেয়ে ইয়ু সেতুর মাঝখানে পৌঁছে সেতুর নিচে বিশাল বিশাল ঢেউ দেখে ভয়ে থেমে যায়! পরে স্থানীয় কর্মীর হাত ধরে নদী পার হয় ইয়ু।

 

ইয়ু’র ভাগ্য এখন অনেক বদলে গেছে।

ভালোবাসার সেতু তৈরি হওয়ার পর সমাজের বিভিন্ন মহলের উষ্ণহৃদয় মানুষের সাহায্যে ইয়ু গ্রাম থেকে বের হয়ে খুন মিং এবং বেইজিংয়ের মত বড় বড় শহরে ভ্রমণ করতে পেরেছে। সে প্রথমবারের মত নু চিয়াং নদীর বাইরের চমত্কার বিশ্ব দেখতে পেয়েছে।

ইয়ু বলে: সে যেন অন্ধকার পথ থেকে এক-একটি উজ্জ্বল বাতি দেখতে পাচ্ছে। জীবন এখন আর এত কঠিন নয়। তাই আমি লেখাপড়ার জন্য আরো বেশি করে চেষ্টা করছি।

২০১৮ সালে মেয়ে ইয়ু খুনমিং-এর এক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সক্ষম হয়। সে তার গ্রামের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।

ইয়ু’র লেখাপড়া সঙ্গে সঙ্গে নু চিয়াং-এর দুই তীরের দারিদ্র্যবিমোচন এবং গ্রামীণ পুনরুদ্ধার ঘটেছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ইয়ুননানের সংখ্যালঘু জাতির দারিদ্র্যবিমোচন এবং জীবনের উন্নয়নের ওপর অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, চীনের সচ্ছল সমাজ গঠনের পথে সংখ্যালঘু জাতির কোনও মানুষকেই পেছনে রাখা যাবে না।

 

দেশের আর্থিক সহায়তায় ইয়ু-এর পরিবার পাহাড় থেকে নদীর তীরে স্থানান্তরিত হয়েছে, নতুন বাড়িঘর তৈরি হয়েছে। তাঁর লেখাপড়ার পেছনে সরকারের বৃত্তি আছে। নু চিয়াং নদীতে প্রাচীন সেই জিপলাইন আর নেই, ২০১৬ সালে নদীতে একটি দৃঢ় লোহার বড় সেতু তৈরি হয়। বিভিন্ন জাতির জনগণের যাতায়াত আরো সুবিধাজনক হয়। আর ইয়ু-এর বাসার নিম্ন অববাহিকায় নতুন করে আরেকটি বড় সেতু নির্মিত হয়েছে।

ইয়ু বলেন: অতীতে অনেক লোক তাঁকে সাহায্য করেছেন। তাদের ছাড়া আজকের ইয়ু এত সুখী জীবন অর্জন করতে পারত না। তাই তিনি সবার সাহায্যের জন্য ভীষণ কৃতজ্ঞ। নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন, জন্মস্থানের দ্রুত উন্নয়ন, দেশ ও সমাজের যত্ন ও সাহায্য, এসব কিছু ইয়ু মনে রেখেছেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সেই দিন থেকে তিনি ডাক্তার হবার পর পরই জন্মস্থানকে প্রতিদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

আগামী সেপ্টেম্বর মাসে ইয়ু হাসপাতালে কাজ শুরু করবেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে তিনি নিশ্চয় নিজের অর্জিত জ্ঞান দিয়ে জন্মস্থানের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় অবদান রাখবেন।