চীনের সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষিকা ম্যাডাম পান ইয়ু লিয়ানের বিশেষ ক্লাস
2022-07-11 11:30:07

চীনের সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে অনেক সংখ্যালঘু জাতির মানুষ বসবাস করেন। এখানে উইগুর ও কাজাখসহ কয়েকটি জাতির মুসলমান দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করে আসছেন। সিনচিয়াংয়ের আয়তন বিশাল। স্থানীয় লোকসংখ্যা আয়তনের তুলনায় কম। কিন্তু স্থানীয় সংখ্যালঘু জাতির বাচ্চাদের শিক্ষার  ওপর অনেক গুরুত্ব দেয় চীনা সরকার। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা সিনচিয়াংয়ের কাশি এলাকার শুলে জেলার একজন সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক পান ইয়ু লিয়ানের মুগ্ধকর গল্প তুলে ধরবো। তিনি টানা কয়েক দশক ধরে স্থানীয় বাচ্চাদের পড়াশোনায় সহায়তা দিয়ে আসছেন।

পান ইয়ু লিয়ান ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হান জাতির এবং মা উইগুর জাতির। ছোটবেলা থেকে তিনি সিনচিয়াংয়ে বড় হয়েছেন এবং যুবকালে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে ব্যবসা করেছেন। তাই তিনি চমত্কার ম্যান্ডারিন, উইগুর ভাষা, কাজাখ ভাষা ও তিব্বতী ভাষা পড়তে পারেন। ১৯৯২ সালে যখন তিনি সিনচিয়াংয়ের শুলে জেলায় ফিরে আসেন, তখন খেয়াল করেন যে, গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে অনেক পরিবারে বাচ্চাদের দেখাশোনা করার কেউ থাকে না। তখন থেকে তিনি বিনা খরচে বাচ্চাদের জন্য একটি ক্লাস চালু করেন এবং তাদের খাওয়া-থাকার পাশাপাশি বিভিন্ন জ্ঞান শেখাতে থাকেন। শুরুর দিকে প্রতিদিন মাত্র কয়েকজন বাচ্চা তার বাসায় আসতো। তবে তিনি প্রতিদিন মনোযোগ দিয়ে ক্লাসের বিষয়বস্তুর ওপর প্রস্তুতি নিতেন। পরে ক্লাসের বাচ্চাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে এবং  ম্যাডাম পানের ক্লাসও সুপরিচিত হয়ে ওঠে।

পান ইয়ু লিয়ানের বাড়িতে কেবল কয়েকটি পুরনো আসবাবপত্র রয়েছে। বাড়িতে সবচেয়ে বড় রুম ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং সেখানে একটি কালোবোর্ড, কয়েকটি টেবিল ও ১০টিরও বেশি চেয়ার আছে। প্রতিদিন স্কুলের ক্লাস শেষ করার আগে তিনি বাচ্চাদের জন্য পানি সিদ্ধ করেন। এসময় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ফলে তার দু’টি পা বেশ ক্লান্ত হয়। তখন তিনি বসে বসে তাদের ক্লাস নেন। নিজের খরচে প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্যপুস্তক কিনে ফেলেন তিনি।

প্রতিমাসে তাঁর মাসিক বেতন সাধারণ জীবনযাপনের চাহিদা মেটানো ও বাচ্চাদের জন্য স্টেশনারি কিনতে ব্যবহার করেন তিনি। টাকা যথেষ্ঠ না হলে তিনি বর্জ্য সংগ্রহ করে তা বিক্রি করেন এবং টাকা উপার্জন করেন। স্থানীয় আবাসিক কমিউনিটির প্রধান হিসেবে তিনিও কিছু পয়সা পান। এসব টাকাও বাচ্চাদের পড়াশোনায় উত্সাহ দিতে ছোটখাটো পুরস্কার কিনে ব্যয় করেন। প্রতিদিন কেবল ক্লাসের বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন তিনি, এমন নয়, তাঁর নিজের ছেলে অসুস্থ হয়ে বিছানায় অবশ হয়ে পড়ে আছে এবং নিজের নাতনীও আছে। তাদের যত্ন নিতে হয় তাকে। যদিও নিজের পরিবার নিয়েই অনেক চাপের মধ্যে থাকেন তিনি, তথাপি অন্য পরিবারের বাচ্চাদের যত্ন নিতে প্রচেষ্টা চালান।

বর্তমানে ম্যাডাম পানের বয়স ৮০ বছরেরও বেশি। তবে তিনি এখনও ক্লাস বন্ধ করার পরিকল্পনা করেননি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় আশা উইগুর জাতির বাচ্চাদের বড় হওয়ার পর দেশের জন্য কার্যকর ও সেরা ব্যক্তিতে পরিণত করা। আমার শরীরে যতদিন কুলাবে, ততদিন এই ক্লাস অব্যাহত রাখতে চাই।”

যদিও তাঁর নিজের শরীরের অবস্থাও দুর্বল, তবে যখন কালোবোর্ডের সামনে দাঁড়ান, তখন অনেক মনোযোগ দিয়ে শিক্ষকের কাজ করে থাকেন। টানা ৩০ বছরে তিনি বিনা খরচে মোট ২৩০০ জনেরও বেশি বাচ্চার যত্ন নিয়েছেন।

প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় শিক্ষক পানের বাড়িতে ক্লাস সময়মতো শুরু হয় এবং বাচ্চারা অনেক মনোযোগ দিয়ে হোমওয়ার্ক করে। শিক্ষক পানের কাছ থেকে তারা অজানা বিষয় জানতে পারে।

২০১৯ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নতুন সদস্য হিসেবে তিনি যোগ দেন এবং নিজের অবদান সম্পর্কে ম্যাডাম পান ইয়ু লিয়ান বলেন, ‘আমি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য।  তাই আমার এমন দায়িত্ব আছে। বাচ্চাদের যত্ন নেওয়া আমার অবসরের পর একটি তাত্পর্যসম্পন্ন ব্যাপার। নিজের আপন বাচ্চা দেখাশোনার মতো সকল বাচ্চাদের যত্ন নিলে, বাচ্চারাও আমার মনকে অনুভব করতে পারে এবং আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়।” ম্যাডাম পানের দৃষ্টিতে কেবল স্কুলের পরে বাচ্চাদের যত্ন নেওয়া বা তাদের পড়াশোনায় সহায়তা দেওয়া তাঁর মূল কাজ নয়, বরং তাদের নৈতিকতার চর্চায় নিজের ভুমিকা পালন করে থাকেন। বাচ্চারা শুধু জ্ঞান শেখে না, তাদের জন্য অন্যদের সম্মান করা, মহত্ চরিত্র গঠন করা আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

ম্যাডাম পান ইয়ু লিয়ানের প্রতিবেশী আহমেদ মেমেদি পানের আন্তরিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। এক শরত্কালের রাতে আবাসিক কমিউনিটির পানির পাইপলাইন ভেঙ্গে যায়। তখন অনেক পানি রাস্তায় প্রবাহিত হয়। এ দৃশ্য দেখে ম্যাডাম পান কয়েকজন লোক ডেকে কলের গেট বন্ধ করেন এবং সারারাত পাইপলাইন ঠিক করেন। তাঁর এমন দায়িত্বশীল মনোভাব সবার প্রশংসা পেয়েছে।

পানের ক্লাসরুমে একটি স্লোগান দেখা যায়। সেটি হলো: ‘ভালোবাসা শিক্ষার মূল ব্যাপার। ভালোবাসা না থাকলে শিক্ষাদানও অকার্যকর হয়ে যাবে।’ শিক্ষক পানের প্রভাবে বাচ্চারা অনেক মিতব্যয়ী হয়েছে। চক অনেক ছোট হয়ে গেলেও তারা সেগুলো ব্যবহার করে। এ সম্পর্কে পান বলেন, মিতব্যয়িতা অনেক ভালো।

মেয়ে জিয়ানমু সিনুর পানের ছাত্রীদের অন্যতম। তার বাবা-মা সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। তাই ছোটবেলা থেকে ম্যাডাম পানকে মেয়ের যত্ন নিতে অনুরোধ করেন তাঁর বাবা-মা। প্রাথমিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণী থেকে জিয়ানমু সিনুর পানের ক্লাসে যোগ দেয় এবং কম সময়ের মধ্যে তার লেখাপড়ার ফলাফল ব্যাপক উন্নত হয়। বর্তমানে মেয়ে জিয়ানমু সিনুর শুলে জেলার পিপলস হাসপাতালের একজন নার্স। তিনি মনোযোগ দিয়ে রোগীদের যত্ন নেন এবং ম্যাডাম পানের ক্লাসের কথা স্মরণ করে বলেন, “নানী পানের কাছ থেকে আমি পরিশ্রম ও মনোযোগ দিয়ে কাজ করার অভ্যাস শিখেছি। তিনি আমার জীবনের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ।”

উলায়িনমু কাদির শিক্ষক পানকে খুব ভালো করে চেনেন। বাচ্চাদের শিক্ষাদান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডাম পানের সাথে ২০ বছর ধরে পরিচিত। তিনি যেন আমাদের পরিবারের সদস্যের মতো। তাঁকে ছাড়া আমরা সঠিকভাবে বাচ্চাদের শিক্ষাদান করতে পারতাম না।” উলায়িনমু আবাসিক কমিউনিটির দলের প্রধান। তাঁর স্ত্রী বেকার এবং দু’জন বাচ্চা আছে। তিনি একাই পরিবারের আর্থিক বোঝা বহন করেন। তার অবস্থা জেনে ম্যাডাম পান বলেন, ‘আমি তোমার বাচ্চাদের পড়াশোনায় যত্ন নেব।’ তা ছাড়া, তিনি বাচ্চাদের জন্য নিয়মিত খাবার রান্না করেন, নিজের টাকা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য নতুন কাপড়চোপড় ও জুতা কেনেন। পরে পানের নাতনীর সাইকেলও বাচ্চাদের দিয়েছেন। উলায়িনমু বলেন, “আমার পিতামাতা যখন আমার ১৭ বছর বয়সে মারা যান, ম্যাডাম পান তখন থেকেই আমার কাছে মায়ের মতো আপন মানুষ।”

উইগুর জাতির নারী রেহাগু ইয়াসেন একাই দু’জন বাচ্চার যত্ন নেন এবং একটি ছোট দোকান চালান। ২০১৬ সালের জুন মাসে তার দোকানে চুরি হয়। তখন টাকার অভাবের কারণে তার জীবনে অনেক ঝামেলা নেমে আসে। ম্যাডাম পান তাঁর অবস্থা জেনে ২০০০ ইউয়ান দান করেন। তখন তাকে উত্সাহ দিয়ে পান বলেন, “আমাদের জীবনে অনেক কষ্টকর মুহূর্ত কাটাতে হয়। কেবল সামনে এগিয়ে গেলে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে।” তাঁর কথা শুনে রেহাগু অনেক মুগ্ধ হন। তিনি বলেন, “ম্যাডাম পান যে-কোনো জাতির লোকদের সাহায্য করেন। তিনি খুবই ভালো ও আন্তরিক মানুষ। আমরা সবাই তার প্রতি কৃতজ্ঞ।”

চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ৮০ বছর বয়সের ম্যাডাম পান ইয়ু লিয়ান পড়ে যান এবং শরীরের হাড় ভেঙ্গে ফেলেন। তখন ১০ জনেরও বেশি বাচ্চা হাসপাতালে তাঁর যত্ন নেয়। তারা সবাই নিজেদের পানের আপন বাচ্চা বলে মনে করে। ইউয়েরিকুলি মেমেদি তাদের একজন। অতীতকালের জীবন স্মরণ করে তিনি বলেন, “কাশি শহরের সিনশিছু এলাকার আবাসিক কমিউনিটিতে অনেক পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল ছিল। তাই পরিবারের বাবা-মাকে কাজ করতে হয় ও তারা অনেক দেরীতে বাসায় ফেরে। বাচ্চাদের পড়াশোনায় কোনো সাহায্যও করতে পারেন না। ম্যাডাম পানের বাবা হান জাতির লোক। তাই তাঁর ম্যান্ডারিন অনেক ভালো। তাঁর মা উইগুর জাতির, তাই তাঁর উইগুর ভাষাও ভালো। তাই তিনি সহজে বিভিন্ন জাতির বাচ্চাদের লেখাপড়ায় সহায়তা দিতে পারেন। মেয়ে  রেহাগু ইয়াসেন স্মরণ করে বলেন, ম্যাডাম পানের চীনা ভাষার ক্লাস বেশ ভালো। স্কুলে যেসব বিষয় তিনি বুঝতেন না, সেসব বিষয় পানের ক্লাসে বুঝে নিতেন। পানের বাসায় একটি বড় নোটবুক রয়েছে। সেখানে ২০০০ জনেরও বেশি বাচ্চার তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাদের নাম, বাড়ির ঠিকানা, বাবা-মায়ের যোগাযোগ নম্বর এবং বাচ্চাদের চরিত্র—সবকিছুই বিস্তারিত লেখা আছে তাতে। যারা পানের ক্লাসে পড়াশোনা করেছেন, তাদের কেবল পড়াশোনার উন্নতি হয়েছে তা নয়, বরং তারার নৈতিকতার দিক দিয়েও উন্নতি করেছে।

নার্স সিয়েমুসিনুর মেমেতি বলেন, “নানী পানের ক্লাসরুমে অনেক মজার মজার খাবার পাওয়া যায়। তিনি আমাদের জন্য আপেল ও মিছরিসহ বিভিন্ন খাবার নিয়ে আসতেন। তবে তাঁর টাকা অনেক কম ছিল। তিনি নিয়মিত বর্জ্য সংগ্রহ করে বিক্রি করে টাকা উপার্জন করতেন। প্রতিবেশীরা জানেন পান তাদের টাকা গ্রহণ করবেন না। তাই অনেকে রুটি ও নানসহ বিভিন্ন খাবার পানের ক্লাসে নিয়ে আসতেন।”

গত কয়েক বছর ধরে মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে পানের ক্লাস সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। এখন স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে আরেকটি নতুন ক্লাসরুম চালু হয়েছে। আবাসিক কমিউনিটি নতুন ক্লাসরুম নির্মাণ করার সাথে সাথে শিক্ষক পানের জন্য নতুন হোস্টেলও স্থাপন করেছে। ক্লাসে নতুন স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নতুন শিক্ষক বাচ্চাদের নৃত্য ও চারুকলায় প্রশিক্ষণ দেন।

সবার যৌথ প্রয়াসে ম্যাডাম পানের ক্লাস অব্যাহত আছে। সবার যত্নে পানের শরীরও দিন দিন পুনরুদ্ধার হচ্ছে। আশা করি, তিনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং শুলে জেলার বাচ্চাদের ক্লাসও আগের মতো মজাদার ও হৃদয়গ্রাহী থাকবে।

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)