চীন-পাক বন্ধুত্বের প্রতীক করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র
2022-07-11 13:55:10

পাকিস্তানের করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের মাস্টার-কন্ট্রোল রুমে দশ-বার জন চীনা ও পাকিস্তানের কর্মী কেন্দ্রের বিভিন্ন তথ্য নিয়ে পরিসংখ্যান, হিসাব ও বিশ্লেষণ করছেন। কন্ট্রোল রুমের বাইরে চারটি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র ইউনিটের রাউটার দ্রুততার সাথে ঘুরে জলের প্রবাহকে বিদ্যুতে রূপান্তর করছে। যাতে দেশটির সবুজ টেকসই উন্নয়নের জন্য নতুন চালিকাশক্তি যোগানো যায়।

 

মাস্টার-কন্ট্রোল রুম হচ্ছে করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের “মস্তিষ্ক”। সেখানে অবস্থিত এক সেট বুদ্ধিমান পর্যবেক্ষণ সিস্টেম ঠিক মানুষের স্নায়ু কেন্দ্রের মতো। সেখানে জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র পরিচালনা করা সংক্রান্ত সকল পরিসংখ্যান আছে। জুন মাস ঠিক পাকিস্তানের  বর্ষাকাল। চীন-পাক যৌথ প্রশিক্ষণের ইনজিনিয়ার নূর জলের অবস্থার বুদ্ধিমান পর্যবেক্ষণ এবং স্বয়ংক্রিয় বন্যা রিলিজ দেখিয়েছেন।

 

কন্ট্রোল রুমের ইনজিনিয়ার ইয়ান সিয়ান বো বলেন, আমাদের ব্যবহৃত জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের কম্পিউটার সুপারভাইজরি কন্ট্রোল সিস্টেমটি চীনের নিজস্ব গবেষণায় উদ্ভাবিত এবং নিজস্ব স্বতন্ত্র মেধা-স্বত্ব দৈত্যবৎ বিশাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র কম্পিউটার সুপারভাইজরি কন্ট্রোল সিস্টেম।

 

চীনের থ্রি গোর্জেস কর্পোরেশন প্রধান বিনিয়োগকারী হিসেবে নির্মিত করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র হচ্ছে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্পের প্রথম জলবিদ্যুত্ বিনিয়োগ প্রকল্প। যা পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের করোট অঞ্চলে অবস্থিত। জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের মোট বিদ্যুত্ উত্পাদন ক্ষমতা ৭২০ মেগাওয়াট। চলতি বছরের ২৯ জুন সার্বিকভাবে চালু হবার পর করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রটি দেশটির পঞ্চম বৃহত্তম জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রে পরিণত হয়। প্রতিবছর ৩,৪৩৬ গিগাওয়াট-ঘন্টা হিসেবে সস্তা দূষণমুক্ত বিদ্যুত্ সরবরাহ করে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের বিদ্যুত্ চাহিদা পূরণ করবে এবং কার্যকরভাবে দেশটির বিদ্যুত্ সরবরাহ-চাহিদা মেটাবে।

 

ইয়াংজি থ্রি গোর্জেস টেকনোলজি অ্যান্ড ইকোনমি ডেভেলপমেন্ট কোং লিমিটেডের (টিজিডিসি) ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হৌ চিয়ান গাং বলেন, করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রটি টিজিডিসির চীনা মানদণ্ড চীনের জলবিদ্যুত্ ডিজাইন, নির্মাণ, সাজ-সরঞ্জাম এবং নির্মাণ প্রশাসন পূর্ণাঙ্গ শিল্প চেইন পুনর্বিন্যাস করা বিদেশী দৃষ্টান্তমূলক প্রকল্প। প্রকল্পে সকল সাজ-সরঞ্জামের ৯৫ শতাংশেরও বেশি সরবরাহকারী চীন।

 

করোট প্রকল্পের ডিজাইন কর্তৃপক্ষ হিসেবে সিআইএসপিডিআর কর্পারেশন অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে, প্রকল্প ডিজাইনের জন্য সমাধান পরিকল্পনা প্রদান করে। করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র কোম্পানির দায়িত্বশীল ব্যক্তি তোং শিয়াও নিং জানান, জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের প্রকল্প অঞ্চল প্রধানত নরম শিলা ভূতাত্ত্বিক এবং পরিবেশ পরিবর্তনের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। সুতরাং জলবিদ্যুত্ বাঁধের নির্মাণ খুবই চ্যালেঞ্জিং। উপযুক্ত নির্মাণ স্থান পাওয়ার জন্য আমরা বিপুলহারে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার সাইট ও রোলিং কম্প্যাকশন পরীক্ষা করেছি। আমরা চীনের অ্যাসফাল্ট কংক্রিট কোর-ওয়াল রকফিল বাঁধ প্রযুক্তি করোট জলবিদ্যুত্ প্রকল্পে ব্যবহার করেছি।

 

নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে যে, আমি করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র প্রকল্পে চীনা প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার স্বচক্ষে দেখেছি। প্রকল্পটি অনেক পাকিস্তানির জীবন উন্নত করার পাশাপাশি দেশটির বিদ্যুত্ শক্তির চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা প্রশমিত করবে। করোট প্রকল্পে পাকিস্তানের বিদ্যুতশক্তি ইনজিনিয়ার মোহাম্মদ আলী মাহমুদ এসব বলেন।

 

করোট বিদ্যুত্ শক্তি লিমিটেড কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ওয়াং মিন শেং বলেন, করোট জলবিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্পটিতে পাকিস্তানের সমৃদ্ধ জল শক্তি ব্যবহার করা হবে। প্রকল্পটি অধিকতরভাবে দেশটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে।

 

অনুমান অনুযায়ী, করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র প্রকল্পটি প্রতিবছর ৩৫ লাখ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমাবে। করোট প্রকল্প কোম্পানির সহকারী জেনারেল ম্যানেজার লেই জেন বলেন, দূষিত পানি প্রশাসন, আবর্জনার পুনর্বাসন এবং নিকটবর্তী জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করেছি আমরা। যাতে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের নির্মাণের প্রভাব সর্বনিম্ন করা যায়।

 

করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের আশপাশে অধিবাসীদের জীবনযাপনের শর্ত উন্নত করার জন্য থ্রি গোর্জেস কর্পোরেশন প্রকল্প সরকারের সঙ্গে গভীরভাবে সহযোগিতা করে মাঝারি ও প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাসপাতাল, রাজপথ, পার্ক ও পানি সরবরাহ সাজ-সরঞ্জামসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এছাড়া, “চীনের থ্রি গোর্জেস-পাকিস্তান বৃত্তি” স্থাপন করে, যাতে পাকিস্তানি ছাত্র-ছাত্রীরা চীনে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে পারে।

 

করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য মালিক বিলাল তারিক পরিবার নিয়ে বাঁধ এলাকা ত্যাগ করেছেন। তিনি বলেন, জলবিদ্যুত্ প্রকল্প গ্রুপ তাঁর পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার পাশাপাশি তাকে নিকটবর্তী গ্রামে নতুন বাসস্থান সরবরাহ করেছে। এছাড়া, প্রকল্প গ্রুপ চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার জন্য মালিকের জন্য ইনজিনিয়ার বিষয় শিখার বৃত্তি প্রদান করেছে।

 

“এসব আমার জীবনকে পরিবর্তন করেছে। আমি নিম্ন-মধ্য আয়ের পরিবার থেকে এসেছি। আমার ভাই-বোন মোট ৮জন। আমার বাবা-মা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে দিতে পারেন না। চীনা প্রতিষ্ঠান বৃত্তি প্রদান করার ফলে আমি পুরো পরিবারে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করার মানুষে পরিণত হই”। মালিক গর্বিতভাবে বলেন, দু’বছর আগে তিনি লেখাপড়া শেষ করে স্বদেশে ফিরে সুষ্ঠুভাবে করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। স্থিতিশীল আয় পেয়ে তিনি পরিবারের অর্থনৈতিক চাপ ভাগাভাগি করতে পেরেছেন।

 

জানা গেছে, করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের ৭ বছরের নির্মাণ প্রক্রিয়ায় প্রায় কয়েক লাখ চীনা-পাক কর্মী এখানে কাজ করেছেন। অধিকাংশ স্থানীয় অধিবাসী। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ স্থানীয় অঞ্চলের জন্য নতুন সেতু ও স্কুল নির্মাণ করেছে। অবকাঠামো পরিবেশ উন্নত করার পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছে।

চলতি বছরের ২৫ মে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ শাহবাজ শরীফ বলেছেন, চীন-পাক অর্থনৈতিক করিডোরের প্রথম জলবিদ্যুত্ বিনিয়োগ প্রকল্প হিসেবে করোট জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র দেশটির জন্য দূষণমুক্ত ও সস্তা বিদ্যুত সরবরাহ করবে এবং দেশটির সবুজ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে।

 

(প্রেমা/এনাম)