কোরবানীর ধর্মীয়-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও অর্থনৈতিক প্রভাব
2022-07-10 19:22:51

করোনা মহামারিতে গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে স্বাভাবিক উৎসব মুখরতায় ইদ উদযাপন করতে পারেননি বাংলাদেশের মানুষ। এর মধ্য অনেক ইদে বিধিনিষেধ থাকায় ইদগাহে ইদের জামাত হয়নি। গত রোজার ইদে বিধিনিষেধ না থাকলেও বৈরি আবহাওয়ার কারণে দেশের অনেক জায়গায় ইদগাহে ইদ-জামাত হয়নি। তবে এবার করোনা সংক্রমণ কিছুটা বাড়তির দিকে থাকলেও ইদগাহে জামাতের বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। তাই উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবাগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে এবার পবিত্র ইদুল আজহা উদযাপিত হচ্ছে বাংলাদেশে।

ইদ-জামাতে খুতবায় মনের পশুকে কোরবানী দেওয়ার আহ্বান জানান ইমামরা। দেশের মানুষের কল্যাণ ও সুখ-সমৃদ্ধি, মুসলিম উম্মাহ ও বিশ্ব মানতবার কল্যাণ কামনায় মোনাজাত করা হয়।

নামাজ শেষে ধর্মপ্রাণ মুসলমান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পশু কোরবাণী দেন। কোরবাণীর মাংসের বেশির ভাগ বিলিয়ে দেওয়া হয় গরীব-দুঃখীর মাঝে।

কোরবানীর ধর্মীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের বাইরে এর রয়েছে বড় অর্থনৈতিক প্রভাব। প্রতিবছরই কোরবানীর ইদে সামনে আসে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এর একটি হচ্ছে কোরবানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। রাজধানী ঢাকায় কোরবানীর জন্য কিছু স্থান নির্ধারণ করা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া নির্ধারিত স্থানে যেতেও নগরবাসী খুব আগ্রহী নয়। তাই বেশির ভাগ কোরবানীই হয় বাড়ির সামনে, রাস্তার পাশে। পশুর রক্ত আর বর্জ্যে নগরীর পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়।

এ পরিস্থিতি সামাল দিতে গত ক’বছর ধরে ঢাকার দুই সিটির মেয়র দ্রুত বর্জ্য অপসারণের উদ্যোগ নেন। তাদের এ উদ্যোগ ফলপ্রসুও হয়েছে। যেখানে একসময় রাজধানীর অলিগলিতে দু’চারদিন এমনকি সপ্তাহ ধরেও পশুর বর্জ্য পড়ে থাকতো তা ২৪ ঘন্টার মধ্যে অপসারণে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন ঢাকার নগরপিতারা।

এবার, ১২ ঘন্টার মধ্যে কোরবানির বর্জ্য অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছেন দুই সিটি মেয়র। তারা জানিয়েছেন, ১২ ঘণ্টার মধ্যে কোরবানির বর্জ্য অপসারণের লক্ষ্য নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ বা কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে। যে কোনো সমস্যায় কন্ট্রোল রুমের নম্বরে যোগাযোগ করার কথাও জানান তারা। এ ক্ষেত্রে তারা রাজধানীবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন।

 

কোরবানীতে আরেকটি বড় বিষয়- চামড়া কেনাবেচা নিয়ে প্রতিবছর কোনো না কোনো অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার বিষয় ঘটেই থাকে। চামড়া পাচারের ঘটনাও ঘটে থাকে এ সময়। সরকার অবশ্য আগে থেকেই কোরবানীর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। আশা করা যায় এবার কোরবানীর চামড়া ক্রয়বিক্রয়ে বড় ধরনের কোনো অঘটন ঘটবে না। এবার সারাদেশে ৯০ লাখ পিস কোরবানীর চামড়া সংগ্রহের আশা করছেন আড়তদাররা। বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত এই চামড়া শিল্প। কোরবানীর সময়ই সারা বছরের চামড়ার ৬০-৭০ ভাগ সংগৃহীত হয়।

একটা ভুল ধারনা আছে- কোরবানীর অর্থনীতি বা বাণিজ্য বলতে অনেক শুধু চামড়া-বাণিজ্যকে বুঝে থাকেন। তবে প্রকৃতপক্ষে কোরবানীর অর্থনৈতিক প্রভাব অনেক ব্যাপক। কোরবানী দেশের গোটা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে ২০১৮ সালে কমবেশি ৫৫ লাখ গরু ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকায় বেচাকেনা হয়। এ ছাড়াও ৪০ লাখ ছাগল, ভেড়া ও খাসি বাবদ লেনদেন হয় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। খামারের পাশাপাশি কোরবানির পশুই একটা বড় অংশ কেনা হয় গরিবের কাছ থেকে- যারা কোরবানি উপলক্ষে এই পশুগুলো লালন-পালন করেন। এতে গরিব মানুষের হাতে টাকা আসে, তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। গ্রামগঞ্জের বাজারগুলো সচল হয়ে ওঠে। সার্বিকভাবে অর্থনীতির চাকা সচল হয়।

চলতি বছর কোরবানীযোগ্য পশুর সংখ্যা ১ কোটি ২১ হাজারের বেশি। সেই হিসেবে এবার আরও বেশি পশু করোবানী হবে এবং অর্থনৈতিক লেনদেনও সে অনুপাতে বাড়বে।  

শুধু কোরবানীর পশু লালন-পালন নয়- অর্থনীতির অন্য অনেক খাতেও এর সরাসরি প্রভাব রয়েছে। চামড়া শিল্পের কথা আমরা আগেই বলেছি। এর বাইরে গোখাদ্যের একটা বড় বাণিজ্য রয়েছে। গরু জবাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ছুরি-কাঁচি-বঁটি-দা’র ব্যবসা রয়েছে। জবাইয়ের সময় পাটের চট, বাঁশের চাটাই এগুলোর দরকার হয়। আর মাংসের জন্য মশলার বিপুল ব্যবসায়ের সঙ্গে আছে মাংস সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজের ব্যবসায়ও। এর সঙ্গে একস্থানে থেকে অন্যস্থানে গরু আনা-নেওয়া, বেচাকেনায় সহায়তা এবং জবাই ও মাংস তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমের বিনিময় মূল্যও উল্লেখযোগ্য।

সব মিলিয়ে একটি বিরাট অংকের অর্থ কোরবানীকে ঘিরে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই বড় অংকের আর্থিক লেনদেন এবং কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও বড় ভূমিকা রাখে।

মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।