নিউ ওরিয়েন্টালের ইংরেজি শিক্ষক তুং ইয়ু হুই যখন অনলাইনে জনপ্রিয় পণ্য-বিক্রেতা
2022-06-27 16:03:26

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে অনলাইন ব্যবসা দ্রুত উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে। এর সাথে সাথে অনেক সেলিব্রিটি অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। প্রতিদিন তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ অনুষ্ঠান করেন। এটি এখন চীনে একটি নতুন পেশায় পরিণত হয়েছে।

সম্প্রতি চীনের ইংরেজি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান নিউ ওরিয়েন্টালের একজন ইংরেজি শিক্ষক চীনের ওয়েবসাইটে অনেক পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হলেও, অনলাইনে পণ্য বিক্রি শুরু করেন এবং তাঁর সমৃদ্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে এ পেশায় বেশ নাম করেন। পণ্য বিক্রির সময় তিনি ক্রেতাদের অনেক ইংরেজি শব্দ ও জ্ঞান শিখিয়ে দেন। এভাবে তিনি কম সময়ের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এখন তার অনুসারীর সংখ্যা অনেক। আজকের আসরে আমরা শিক্ষক তুং ইয়ু হুই’র গল্প তুলে ধরবো, তাঁর কর্মঅভিজ্ঞতা  শেয়ার করবো।

 

শুরুতে নিউ ওরিয়েন্টাল ইংরেজি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরি। এটি চীনের সুবিখ্যাত ইংরেজি ভাষা প্রশিক্ষণের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ২০০৬ সালে মার্কিন নাসডাক শেয়ার বাজারে নিবন্ধন করেছে কোম্পানিটি। এখানকার শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের বিদেশে পড়াশোনা বা চাকরির জন্য দরকারি ইংরেজি ভাষার পরীক্ষায় পাস করতে সহায়তা করেন। গত ২০ বছর ধরেই চীনা শিক্ষার্থীদের জন্য, বিশেষ করে যারা বিদেশে পড়াশোনা করতে চায় তাদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান।

তবে কোভিড-১৯ মহামারীর পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। নিউ ওরিয়েন্টালের শিক্ষকদের অফলাইন ক্লাস নেওয়ার সুযোগ ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। কোম্পানির শেয়ারের মূল্য সর্বোচ্চ দামের চেয়ে ৯০ শতাংশ হ্রাস পায়। প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষক কোম্পানি ত্যাগ করে নতুন চাকরিতে ঢোকেন। যারা কোম্পানিতে থেকে যান, তাদের কেউ কেউ অনলাইনে পণ্য বিক্রি করা শুরু করেন। শিক্ষক তুং ইয়ু হুই তাদের মধ্যে একজন।

তিনি যখন নিউ ওরিয়েন্টালের শিক্ষক ছিলেন, তখন তাঁর ক্লাস অনলাইনে খুব জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু ইন্টারনেটে পণ্য বিক্রি শুরুর পর তার ওয়েবসাইটের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।

কারণ, তিনি এ প্ল্যাটফর্মে কেবল পণ্য বিক্রি করেন না, বরং ক্রেতাদের অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য দেন এবং ইংরেজি ভাষা শেখান। তাই তাকে অনেকই দোভাষী শিক্ষক হিসেবে গণ্য করেন। জিনিস কেনার  সাথে সাথে অনেককিছু তারা শিখে নেন শিক্ষকের কাছ থেকে। এটা ক্রেতাদের জন্য বেশ আকর্ষণীয় একটি ব্যাপার।

১০ই জুন নিউ ওরিয়েন্টালের লাইভ অনুষ্ঠান সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইয়ু মিন হং নিজে কৃষিজাত পণ্য বিক্রি করতে শুরু করেন। তখন লাইভ অনুষ্ঠান একসঙ্গে দেখছিলেন প্রায় এক লাখ দর্শক-শ্রোতা। সেদিন অনলাইনে পণ্য বিক্রির পরিমাণ এক কোটি ইউয়ান ছাঁড়িয়ে যায় এবং নতুন ফলোয়ারের সংখ্যা ৩.২ লাখে উন্নীত হয়।

১০ থেকে ১২ই জুন টানা তিন দিনে নতুন ফলোয়ারের সংখ্যা ২০ লাখে উন্নীত হয়। শিক্ষক তুং ইয়ু হুই এ লাইভ অনুষ্ঠানে স্টেক বিক্রি করেন। তবে তিনি স্টেক খাওয়ার পদ্ধতি ও মাংস বেছে নেওয়ার টিপসসহ বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন এবং যেহেতু স্টেক পাশ্চাত্যের খাবার, তাই স্টেক খাওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইংরেজি শব্দ ও বাক্য ক্রেতাদের শিখিয়ে দেন। তা ছাড়া, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত চিংড়ি মাছ বিক্রির সময় তিনি বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন সাইজের চিংড়ি মাছের নামের ইংরেজি বানানের পার্থক্যের সাথেও ক্রেতাদের পরিচয় করিয়ে দেন। এভাবে দশর্করা খাবার কেনার সাথে সাথে নিউ ওরিয়েন্টাল স্কুলে পড়ার অনুভূতি পায়। তবে এ ক্লাস বিনা খরচের। শিক্ষক তুং মনোযোগ দিয়ে কৃষিজাত পণ্য বিক্রি করেন এবং তাঁর সাদা বোর্ডে বিভিন্ন ইংরেজি শব্দের বানান ও অর্থ বুঝিয়ে দেন। এমন পদ্ধতি ক্রেতাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।

আসলে ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর নিউ ওরিয়েন্টাল কোম্পানি অনলাইনের লাইভ স্টুডিও চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমবারের লাইভ অনুষ্ঠানে ইয়ু মিন হংয়ের প্রচেষ্টায় প্রায় ৫০ লাখ ইউয়ানের পন্য বিক্রি হয়। তবে পরের দুই মাসের মধ্যে মোট ২৬টি লাইভ অনুষ্ঠানে তারা শুধু ৪৫ লাখ ইউয়ানেরও  জিনিস বিক্রি করতে সক্ষম হন। সেটি কোম্পানির জন্য অতি বিপজ্জনক মুহুর্ত ছিল। এ সম্পর্কে কোম্পানির আরেকজন শিক্ষিকা ইয়োইয়ো বলেন, “সেই সময় আমাদের লাইভ স্টুডিওতে লোক খুবই কম ছিল। তবে শিক্ষক তুং আসার পর তিনি কবিতা ও উপন্যাসের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্যের পরিচয় দিতে থাকেন। তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে কথা বলেন। তাঁর কথায় আবেগ থাকে, মজার মজার বিষয় থাকে, যা দর্শকদের আকর্ষণ করে।” দর্শক ও ক্রেতা মিস পাই মনে করেন, শিক্ষক তুং বেশ জানাশোনা মানুষ। তাই তাঁর কথা শুনতে শুনতে সময় দ্রুত পার হয়ে যায়। তিনি কখনও জিনিস কিনতে ক্রেতাদের জোর করেন না। তিনি শুধু পণ্যের বর্ণনা দিয়ে যান মজার মজার পদ্ধতিতে।

শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় জুন মাসের মধ্যে নিউ ওরিয়েন্টালের শেয়ারের মূল্য ৩৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। সেটি কেবল শিক্ষকদের প্রচেষ্টার ফলে নয়, বরং কৃষিজাত পণ্যের দাম হ্রাসও এর একটি কারণ। এখন নিউ ওরিয়েন্টালের পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ চেইনও পরিবর্তন হয়েছে। ফলে তাদের দ্রব্যের দাম আগের চেয়ে অনেক সস্তা হয়েছে। সেটিও ক্রেতাদের জন্য সুখবর।

তা ছাড়া, কৃষিজাত দ্রব্যের প্রতিযোগিতা অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের তুলনায় তুমুল নয়। যারা নিউ ওরিয়েন্টালের লাইভ স্টুডিও থেকে দ্রব্য কিনে থাকেন, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা তুলনামূলকভাবে বেশি। কোম্পানির ব্যবসার দ্রুত প্রবৃদ্ধি থেকেও বোঝা যায়, চীনের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো নিউ ওরিয়েন্টালের লাইভ অনুষ্ঠানকে আপন করে নিয়েছে। তবে কৃষিজাত দ্রব্য বা সীফুডের ক্ষেত্রে নষ্টের হার বেশি। মাল পরিবহনের চাপও বেশি। তাই শুধু কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রি করা যথেষ্ঠ নয়। এ পরিস্থিতিতে এখন নিউ ওরিয়েন্টালের বই বা সফটওয়ার বিক্রির শিক্ষক দলও গঠিত হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন ধরনের পণ্যদ্রব্য বিভিন্ন ক্রেতার চাহিদা মেটাতে পারছে।

শিক্ষক তুং ইয়ু হুই জুন মাস থেকে সারা চীনে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। নিজের জনপ্রিয়তা  সম্পর্কে তিনি বলেন, “ছোটবেলায় আমি পাহাড়াঞ্চলের গ্রামে বড় হয়েছি। আমার দাদা দাদীও হুপেই প্রদেশের দূরবর্তী পাহাড়াঞ্চল থেকে শাআনসি প্রদেশে আসেন। আমার পরিবার সাধারণ গ্রামের পরিবার। তাই ছোটবেলা থেকে ভালো করে পড়াশোনা করা ছিল আমার বড় শহরে টিকে থাকার একমাত্র পদ্ধতি।” নিজের চেহারা সম্পর্কে তিনি মজা করে বলেন, “আমার চেহারা তেমন ভালো না।”  যখন তিনি পণ্যদ্রব্য বিক্রি করেন, তখন সহজে কবিতা আবৃত্তি  করেন বা উপন্যাসের পরিচয় দেন। তাঁর লাইভ অনুষ্ঠান দেখা যেন টক শো দেখার মতো, বেশ মজাদার ব্যাপার। এ সম্পর্কে দর্শকরা মনে করেন, জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে টাকা দিয়ে পণ্যদ্রব্যও পাওয়া যায়, সেটি বেশ ভালো ব্যাপার।

কেবল সুন্দর ভাষা দিয়ে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করা নয়, তিনি ঐতিহ্যিক গল্প ও জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাও শেয়ার করে থাকেন। যেমন, আইসক্রিম বিক্রি করার সময় তাঁর ছোটবেলায় আইসক্রিম খাওয়ার স্মৃতি তুলে ধরেন; চাউল বিক্রি করার সময় ধান চাষের প্রক্রিয়ার সাথে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেন। অনেকেই এটা খুব পছন্দ করেন।

শিক্ষক তুং জনপ্রিয় হওয়ার এক সপ্তাহ পর নিউ ওরিয়েন্টাল লাইভ স্টুডিওয়ের দর্শক সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যায় এবং কোম্পানির শেয়ারের দামও ৬ গুণ বেড়ে যায়।

আসলে স্টুডিওতে যোগ দেওয়ার আগে শিক্ষক তুং ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। ২৯ বছর বয়সের যুবক শিক্ষক নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, ‘আমি একজন শিক্ষক ছিলাম এবং বর্তমানে বিক্রেতায় পরিণত হয়েছি।” ২০১৫ সালে তিনি শাআনসি প্রদেশের সি’আন বিদেশি ভাষা ইনস্টিডিউট থেকে স্নাতক হওয়ার পর নিউ ওরিয়েন্টাল কোম্পানিতে যোগ দেন এবং টানা ৭ বছর প্রায় ৫ লাখ শিক্ষার্থীকে ইংরেজি শেখান।

যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হওয়ার সময় তিনি ৩টি চাকরির অফার পেয়েছিলেন এবং প্রতি চাকরির বার্ষিক বেতন ২ লাখ ইউয়ানেরও বেশি, কিন্তু তিনি নিউ ওরিয়েন্টালের চাকরি বেছে নেন। আসলে ছোটবেলায় তাঁর ভালো শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়নি। তাই ইংরেজি ভাষায় তিনি বরাবরই দুর্বল ছিলেন। মাধ্যমিক স্কুলে প্রথমবার ইংরেজি পরীক্ষায় তিনি ক্লাসের সবার চেয়ে কম নম্বর পান। তখন থেকে ভালো করে ইংরেজি শেখার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতিতে চেষ্টা করেন। একসময় তিনি সঠিক পড়াশোনার পদ্ধতি খুঁজে পান এবং মাধ্যমিক স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষে ইংরেজিতে সবাইকে ছাড়িয়ে যান।

নিউ ওরিয়েন্টালে যোগ দেওয়ার সময়ও তিনি হাজার পদপ্রার্থীর মধ্য থেকে নির্বাচিত হন। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২৩ বছর বয়সে তিনি নিউ ওরিয়েন্টালের সবচেয়ে তরুণ বয়সে ইংরেজি শিক্ষা বিভাগের প্রধান হন। যখন নিজের শখ পেশায় পরিণত হয়, তখন দ্রুত অগ্রগতি অর্জিত হয়। এ সম্পর্কে শিক্ষক তুং বলেন, “যখন আপনি প্রিয় কাজটি করেন, তখন আপনার শক্তি কখনও শেষ হবে না।”

নিউ ওরিয়েন্টালের ৭ বছরের কর্মজীবনে তিনি মধ্যরাত পর্যন্ত অফিসে কাজ করেছেন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার শীতকালে তিনি গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। পরিশ্রমের ফল তিনি পেয়েছেন। তবে মহামারীর প্রাদুর্ভাবে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের ‘শীতকাল’ দ্রুত চলে আসে। ২০২১ সালে কোম্পানির শেয়ার মূল্য ৯০ শতাংশ হ্রাস পায়, অপারেটিং আয় ৮০ শতাংশ কমে যায়, এবং ৬০ হাজার কর্মী চাকরি হারান।

তাই কোম্পানি উদ্ধার করতে লাইভ স্টুডিও চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদিও অনেকে শুরুর দিকে তাদের এমন প্রচেষ্টায় ইতিবাচক সাড়া দেননি। তবে টানা ৬ মাসের প্রচেষ্টায় তারা সফল হন। এ সম্পর্কে শিক্ষক তুং স্মরণ করে বলেন, “শুরুর দিকে আমাদের কাজ ব্যাপক স্বীকৃতি পায়নি। তখন অনেক সমালোচনাও সহ্য করতে হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে আমরা ক্রেতাদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছি। জুন মাসে আমাদের লাইভ স্টুডিওতে বিক্রি ২০ কোটি ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়, দৈনিক আয় ৭.৫ লাখ থেকে ৬ কোটি ২৬ লাখে উন্নীত হয়, যাতে কেবল ১০ দিন লেগেছে।”

এ চমত্কার সাফল্যের জন্য শিক্ষক তুং ক্রেতাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি নিজেকে একজন সাধারণ মানুষই মনে করেন। তিনি বই পড়েছেন ও পরিশ্রম করে কিছু সাফল্য অর্জন করেছেন। ক্রেতাদের সামনে সুন্দর গ্রামীণ জীবন, কৃষিদ্রব্য, ও বিভিন্ন বই তুলে ধরে তিনি আনন্দ পান। তবে ইংরেজি ভাষা শেখানো তার মূল কাজ। একদিন আবার তিনি তাঁর আদি পেশায় ফিরে যেতে চান, ফিরে যেতে চান ক্লাসরুমে।

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)