পতিত জমি থেকে ‘খাদ্যের গুদাম’
2022-06-24 18:38:04

চীনে এমন একটি জায়গা আছে, যেখানে জমি এত উর্বর, লোকজন বলে- ‘কালো মাটিতে চিমটি কাটলে তেল বের হয়, চপস্টিক্স মাটিতে রাখলে শস্য উত্পন্ন হয়’। তবে অতীতে সেখানে ছিল শুধু জলাভূমি আর বুনো-নেকড়ে। সেখানে কোনো আবাদি জমি ছিল না। চীনারা কীভাবে অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে সেই অনাবাদি জায়গাকে উর্বর জমি ও শস্যের গুদামে পরিণত করলো? আজ এই বিষয়ে কথা বলবো।

জায়গাটির নাম হল বেইতাহুয়াং। নামের মধ্যে ‘হুয়াং’ শব্দটির অর্থ- পতিত জমি। যা উত্তর-পূর্ব চীনের হেইলুংচিয়াং প্রদেশে অবস্থিত। এর আয়তন ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। আগে জায়গাটি ছিল জনশূন্য ও নির্জন। তবে, এখন বিজ্ঞান বেইতাহুয়াং-এর কৃষি উন্নয়নে সাহায্য করছে।

২০১৮ সালের  নভেম্বর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং হেই লুং চিয়াং প্রদেশ পরিদর্শন করেন। তিনি স্থানীয় ছিসিং কৃষি খামারের বেইতাহুয়াং কৃষি ও কৃষিযন্ত্র কেন্দ্রে যান। তিনি বলেন, বেইতাহুয়াংয়ের বর্তমান অবস্থা উন্নয়ন সহজ কাজ নয়। চীন একে কৌশলগত ঘাঁটি হিসেবে নির্ধারণ করেছে, কৃষিকে কৌশলগত শিল্পে উন্নত করছে। অর্ধ শতাব্দী পর এখানে আকাশ পাতাল পরিবর্তন ঘটেছে। যন্ত্রায়ন, তথ্যায়ন, বুদ্ধিমত্তাকরণ, অসাধারণ সাফল্য এনেছে। বেইতাহুয়াং চীনাদের ক্ষুধা দূরীকরণে বিশাল ভূমিকা পালন করেছে।

অতীতে বেইতাহুয়াং-এ গ্রীষ্মে শুধু জলাভূমি, অনেক বন্যনেকড়ে ও মশার উত্পাত হতো। শীতকালে সবচেয়ে ঠান্ডার সময় তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এক বছরের দুই তৃতীয়াংশই ছিল শীতকাল!

১৯৪৭ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ‘উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ঘাঁটি সুসংবদ্ধ করার’ নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রথম দফা গণ-মুক্তিফৌজ এই ঊষর জমিতে এসে প্রথম কৃষি খামার স্থাপন করে। যা মুক্তিযুদ্ধের ফ্রন্ট লাইনে সমর্থন দিয়েছিল।

নয়া চীন প্রতিষ্ঠার সময়, দেশের সব কিছু উন্নত করা হয়। খাদ্যের অভাব ছিল একটি গুরুতর সমস্যা। তখন বেইতাহুয়াং-এর বিশাল জমিতে শস্য উত্পাদন করা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

নয়া চীনের কৃষিখাতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ওয়াং চেন তখন অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের বেইতাহুয়াংয়ে গিয়ে কৃষি খামার স্থাপনের প্রস্তাব দেন। যাতে বেশি করে শস্য উত্পাদন করা যায়। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে রেল সেনাবাহিনীর প্রথম কৃষি খামার- ‘৮৫০ কৃষি খামার’ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রথম বছরই সেনারা ৯৬.৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পতিত জমি আবাদ করেছে। এই কৃষি খামারের কাজ সবার জন্য দারুণ এক অভিজ্ঞতা। ১৯৫৮ সালে এক লাখ অবসরে যাওয়া সেনা বেইতাহুয়াংয়ে এসে সেখানকার বড় আকারের নির্মাণকাজ দেখে দারুণ উচ্ছ্বসিত হন।

গত শতাব্দীর ৮০ দশকে, অনেক লোক নিজেই পারিবারিক কৃষি খামার তৈরি করার চেষ্টা করে। ক্য বাই লিন দম্পতি তাদের একটি উদাহরণ।

তিনি বলেন, পারিবারিক কৃষি খামার স্থাপন করার অর্থ হলো- উত্পাদনের সব ঝুঁকি নিজেই বহন করা। তখন আমি কারখানার প্রধান থেকে পদত্যাগ করে একটি পতিত জমি আবাদ করার সিদ্ধান্ত নেই। গাড়িতে থাকতাম, ক্ষেতে মাটি দিয়ে চুলা তৈরি করে রান্না করতাম, কাছের পুকুরের পানি পান করতাম।

তিন বছর পরিশ্রমের পর ক্য দম্পতি ৩৩৩ হেক্টর জমি আবাদ করে। তাদের মতো এক একটি স্বাধীন পারিবারিক কৃষি খামার দেশের খাদ্যশস্য উত্পাদনে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

১৯৯৫ সালে বেইতাহুয়াং-এর শস্য উত্পাদনের পরিমাণ প্রথমবারের মত ৫ বিলিয়ন কেজি ছাড়িয়ে যায়। অনেক কষ্ট করে বেইতাহুয়াংয়ের মানুষ অবশেষে একটি সংস্কারের নতুন পথ খুঁজে পায়। ৭০ বছরেরও বেশি সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা অবসরপ্রাপ্ত সেনা, যুবক, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থী এই জমিতে কাজ করে এক একটি বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।

২০২১ সালে ‘বেইতাহুয়াং কৃষি গ্রুপ কোম্পানির’ শস্য চাষ করা জমির আয়তন ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটারে উন্নীত হয়। ২০২০ সালে এখান থেকে শস্য সরবরাহ করা হয় ২০ বিলিয়ন কেজি। যা দেশের মোট শস্য উত্পাদনের ২০ শতাংশ। বেইতাহুয়াংয়ের আগের পতিত জমি এখন সত্যিকারের ‘শস্যের গুদামে’ পরিণত হয়েছে।

এখন বেইতাহুয়াং ‘কৃষি প্রকল্পকে বিমানবাহী জাহাজ’ বলা হয়। শস্য চাষাবাদ, রোপণ, পরিচালনা এবং ফলন—সব কিছুই যন্ত্রের মাধ্যমে করা হয়। সেই সঙ্গে কৃষি খামার স্যাটেলাইট নেভিগেশন, ক্লাউড কাউন্টিংসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি দিয়ে জমি পরিচালনা করা হচ্ছে। এই প্রাণচঞ্চল জমিতে তরুণ-যুবকরা আরো বেশি উন্নয়নের চালিকাশক্তি যুগিয়েছে।