আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছে, দূর থেকে ভেসে আসছে গরুর গলায় ঝুলানো ঘণ্টার আওয়াজ। সেই সময় রাখাল দেরিতে ফিরে আসে এবং পশুপালক লুও চু তখন থেকে ব্যস্ত হতে শুরু করেন। গ্রামের প্রবেশদ্বারের ফাঁকা জায়গায় তিনি দক্ষতার সাথে একটি পর্দা লাগিয়েছিলেন এবং প্রজেক্টর ও সাউন্ড স্ট্যান্ড স্থাপন করেছিলেন। গ্রামের ছেলেমেয়েরা তখনই চারপাশে জড়ো হয়, তাদের প্রিয় সিনেমা দেখার জন্য চিৎকার করে। বয়স্করাও বাড়ি থেকে লম্বা কম্বল টেনে নিয়ে এসে জড়ো হন।
তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ডাংসিয়োং জেলার বালিং গ্রামে গ্রীষ্মের একটি সন্ধ্যা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৩০০ মিটার উঁচুতে তৃণভূমিটি মেঘের সাথে সংযুক্ত, যেন হাত তুলেই মেঘ ধরা যায়। আকাশে ছড়িয়ে থাকা ক্যানভাসের মতো চলচ্চিত্র দেখানোর জন্য একটি পর্দা আছে। ৬২ বছর বয়সী লুও চু স্থানীয় একটি গ্রামীণ জনকল্যাণমূলক চলচ্চিত্র প্রজেকশনিস্ট। ১৯৮৫ সাল থেকে, তিনি ডাংসিয়োং জেলার প্রায় দু’শটি গ্রামে চলচ্চিত্র দেখিয়ে বেড়িয়েছেন।
লুও চু যখন প্রথমবার সিনেমা দেখেন, তখন তার বয়স ছিল ১০ বছর। তার মনে হতো লোহার বাক্সে প্রজেক্টর একটি মূল্যবান বস্তু, যা স্পর্শ করা যায় না এবং পর্দা লাগানোর কাজ প্রত্যেক গ্রামবাসী তাকে সাহায্য করার জন্য ছুটে আসতে চেয়েছিলেন। সেই সময় তিনি কেবল ভেবেছিলেন যে, এত বেশি ‘উঁচু প্রযুক্তির’ সরঞ্জামের অধিকারী প্রজেকশনিস্ট সবচে শক্তিশালী ব্যক্তি। কিন্তু সিনেমার বিষয়বস্তু সম্পর্কে তার খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। তিনি শুধু মনে করতেন যে, বিখ্যাত অভিনেত্রী পর্দায় বেইজিংয়ে গান গাইছেন। সবাই হাততালি দিয়ে সাধুবাদ জানায়।
বিংশ শতাব্দীর ৮০ দশকের শুরুর দিকে জেলায় চলচ্চিত্র প্রজেকশনিস্ট নিয়োগ করা ছিলো। লুও চু, যিনি ‘হাঁটা ট্র্যাক্টর’ চালাতে পারতেন, তিনি স্মার্ট ও পরিশ্রমী ছিলেন। অবশেষে তিনি স্বপ্নের চাকরিটি পেয়ে যান। রিওয়াইন্ড করা এবং পর্দা স্থাপন করা শেখা থেকে শুরু করে, লুও চু চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পথে যাত্রা শুরু করেন।
সেই সময়ে পশুপালকদের সাংস্কৃতিক জীবন তেমন একটা ছিল না। গ্রামবাসীরা এমনকি তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে অন্ধকারে দশ মাইলেরও বেশি পথ হেঁটে পাশের গ্রামে গিয়ে একটি সিনেমা দেখতে পারত। এমনকি তুষারপাতের মধ্যেও তারা কষ্ট করে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতো। ছবির শেষে সবাই পর্দার পাশে নাচতেন এবং আকাশ ভরা তারা’র নীচে একসাথে নাচগানের মাধ্যমে আনন্দ করতেন।
সে সময় লুও চু ছিলেন সবার হৃদয়ে ‘সবচে জনপ্রিয় মানুষ’। স্ক্রিনিং শেষে শিশুরা প্রায়ই তাকে ‘আরেক দিন থাকা’ এবং ‘আরো একবার দেখানোর’ অনুরোধ করত। তার হাঁটা ট্র্যাক্টরে পর্দা, প্রজেক্টর, ফিল্ম, জেনারেটর, সেইসাথে খাবার ও বিছানাপত্র বহন করা হয় এবং একবার ঘুরে বেড়ানোর মিশনে তার তিন মাসেরও বেশি সময় লাগতো।
পরবর্তীতে, লুও চু-এর প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলো পুরানো ফিল্ম থেকে রঙিন ডিজিটাল ছবিতে পরিবর্তন হয়। চলচ্চিত্রের ধরনও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। অ্যাকশন চলচ্চিত্র, যুদ্ধের চলচ্চিত্র, পশুপালন সম্পর্কিত বিজ্ঞান প্রচারকারী চলচ্চিত্র এবং তিব্বতের স্বাধীনতা ও জাতিগত ঐক্যের ইতিহাস সম্পর্কিত চলচ্চিত্র প্রভৃতি। কৃষক ও পশুপালকরা এমনকি সিনেমার তালিকা আগে থেকেই বেছে নিতে পারতেন এবং গ্রামে সিনেমা দেখার জন্য ‘অর্ডার’ করতে পারতেন।
একই সময়ে টিভি ও মোবাইল ফোন ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং সিনেমা দেখার জন্য গ্রামে জড়ো হওয়া এখন আর একমাত্র বিনোদনের উপায় নয়। কিন্তু লোকেরা এখনও লুও চু’র আগমনের প্রত্যাশা করেন, যেন তারা স্মৃতিতে একটি অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করছে। গত ৩৭ বছরে লুও চু তাদের জন্য মালভূমিতে অবস্থিত গ্রামগুলোর রাতের জীবনকে আলোকিত করেছিল এবং উত্তর তিব্বত মালভূমিতে পশুপালকদের সঙ্গে আলোছায়া জগতের একটি সেতু তৈরি করেছেন।
আকাশের নীচে স্ক্রিনের ম্লান আলো বালিং গ্রামের একটি মেয়ের লাল মুখের প্রতিফলন ঘটেছিল। মাত্র ৬ বছর বয়সী মেয়েটি তার দাদীর গায়ে হেলান দিয়ে পর্দার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাচ্ছিলো। প্রথমবার চলচ্চিত্র দেখে তার মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্ন দেখছে। তার চারপাশে চারণ থেকে ফিরে আসা পুরুষরা এবং মেয়েরা, যারা ব্যাংডিয়ান (তিব্বতি এপ্রোন) বুনন শেষ করেছে, তারা সিনেমা দেখতে দেখতে আড্ডা দিচ্ছেন এবং হাসছেন। গ্রামবাসীদের জন্য এই অস্থায়ী ‘সিনেমা হল’ তাদের ‘সামাজিক প্ল্যাটফর্ম’, যার জন্য তারা অপেক্ষা করছে।
২০২১ সালে তিব্বতে প্রায় ৫০০টি তৃণমূলের ফিল্ম স্ক্রিনিং দল জনকল্যাণমূলকভাবে মোট ৬৬ হাজারেরও বেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেছে। হাজার হাজার চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পিছনে রয়েছে তৃণমূল চলচ্চিত্র প্রজেকশনিস্টদের কঠোর পরিশ্রম, যা একটি সুন্দর এবং সুখী তিব্বত নির্মাণে সহায়তা করেছে।
জানা গেছে, তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ফিল্ম পাবলিক সার্ভিস সেন্টার ধীরে ধীরে খোলা জায়গায় সিনেমা প্রদর্শন থেকে ঘরের ভিতরে প্রদর্শন রূপান্তর করার কাজ পরীক্ষামূলকভাবে চালাচ্ছে, ফলে জনসাধারণকে আরও সুবিধাজনক আরো আরামদায়ক চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা দেওয়া যাবে।
লুও চু-এর জন্য তৃণভূমি বা রুমের ভিতর, যাই হোক না কেন, যখন পর্দা থাকে এবং ভিড় হয়- মানুষ তখন খুশি হয়, তখন আমিও সন্তুষ্ট থাকি।