আফ্রিকার শীর্ষ ভবন থেকে নেপালের বৃহত্তম জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র হয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম অবকাঠামো প্রকল্প পর্যন্ত চলতি বছর বেশ কিছু বিদেশী প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে বা পর্যায়ক্রমে সম্পন্ন হওয়ার পথে রয়েছে।
বিদেশী প্রকল্প শুধু স্থানীয় অবকাঠামো পূর্ণাঙ্গ করতে সহায়তা দেয়, তা নয়, বরং প্রচুর কর্মসংস্থান দিয়ে পেশাদার প্রযুক্তিগত কর্মী লালন-পালন করে, স্থানীয় অর্থনৈতিক সমাজ উন্নয়নে সাহায্য করে। একই সময় অগ্রণী চীনা প্রযুক্তি, সরঞ্জাম ও নির্মাণ প্রশাসনসহ “বাইরে যাওয়া” ত্বরান্বিত করে। এ প্রক্রিয়ায় “চীনা নির্মাণ” সোনালী সাইনবোর্ড আরো উজ্জ্বল হয়ে যায়।
চালু হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু
হুমায়ুন হচ্ছেন বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর উত্তর তীরের মাওয়ার একটি ভাজা মুরগির দোকানের মালিক। কিছু দিন আগে তিনি একটি সুখবর শুনেছেন: আট বছরের নির্মাণের পর পদ্মা সেতু চলতি মাসের শেষে চালু হবে।
স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য পদ্মা সেতু একটি “স্বপ্নের সেতু”। দীর্ঘকাল ধরে পদ্মা নদী দেশটিকে দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব দু’টো অংশে বিভক্ত করেছে। নদীপথ অতিরিক্ত প্রশস্ত, দ্রুত প্রবাহ এবং ঘন ঘন বন্যা হবার কারণে নদীর নিম্ন অববাহিকায় সেতু নির্মাণ বাস্তবায়িত হয়নি। বহু বছর ধরে দু’তীরের অধিবাসীরা নদী পার হতে নৌকার উপর নির্ভর করেন।
২০১৪ সালে চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কো. লিমিটেড (এমবিইসি) পদ্মা সেতুর নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করে। দেশটির বৃহত্তম অবকাঠামো প্রকল্প হিসেবে সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৭.৭ কিলোমিটার। ডাবল ইস্পাত ট্রাস মরীচি কাঠামোর উপরে চার লেন হাইওয়ে এবং নিচে একক ট্র্যাক রেলপথ। সেতু নির্মাণ কাজ যথাক্রমে সম্পন্ন হবার সঙ্গে সঙ্গে নদীর দু’তীরের অধিবাসীদের ফেরির মাধ্যমে যাতায়াতকে বিদায় দেবেন।
আট বছরের নির্মাণ চলাকালে পদ্মা নদীর উত্তর তীরে আস্তে আস্তে কারখানা ও ফিলিং স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে। নিকটবর্তী অধিবাসীদের জীবন দিন দিন ভালো হয়েছে। হুমায়ুনের দোকান প্রকল্পের কাছেই অবস্থিত। সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু থেকে তাঁর দোকানের ব্যবসা আরো ভাল হয়েছে। শুরু দিকের রাস্তার পাশে ছোট বুথ থেকে পাল্লা - যুক্ত দরজা থাকা দোকানে পরিণত হয়েছে। সেতু চালু হবার পর ব্যবসা নিশ্চয়ই আরো ভাল হবে। তিনি এমন কথাই বলেছেন।
সড়ক ও রেলপথ চালু হলে সব ক্ষেত্রেই সমৃদ্ধি সৃষ্টি হয়। পদ্মা সেতু চালু হবার পর দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে পণ্য প্রচলন ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের ব্যবস্থা ও নিরুপন অনুযায়ী, “স্বপ্নের সেতু”টি দেশটির জন্য বার্ষিক ১.৫ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি নিয়ে এসে ৮ কোটি মানুষ এখান থেকে লাভবান হবে। পদ্মা সেতু পাশাপাশি “এক অঞ্চল এক পথ” নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন পয়েন্ট এবং চীন ও প্যান-এশিয়া রেলপথের সংযুক্ত পয়েন্ট।
বিদেশে প্রকল্প নির্মাণ করার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় কর্মসংস্থান সরবরাহ করা হয়। সেতুর প্রকল্প বিভাগের বাঙালি কর্মী উজিজা দু’বছরের মধ্যে মাপ নেয়া একজন নতুন কর্মী থেকে মোট স্টেশন, সমতলকরণ যন্ত্র ও জিপিএসসহ বিভিন্ন মাপ নেয়া সরঞ্জাম অপারেশন আয়ত্ত করা সুদক্ষ এক কর্মীতে পরিণত হন। তাঁর জীবনযাপনের মানও স্পষ্ট উন্নত হয়েছে। সাতজন সদস্য নিয়ে গঠিত তার পরিবার ৪০ বর্গমিটারের ছোট ঘর থেকে দু’তলা উজ্জ্বল ও প্রশস্ত নতুন বাসায় স্থানান্তর করা হয়। এমবিইসি’র ডিরেক্টর জেনারেল ওয়েন উ সোং ব্যাখ্যা করে বলেন, নির্মাণকাজ শুরু থেকে তারা ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। নির্মাণ কাজে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাঙালি কর্মীদের পেশাগত দক্ষতাও স্পষ্টভাবে উন্নত হয়েছে। ভবিষ্যতে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবার পর অব্যাহতভাবে স্থানীয় অন্যান্য প্রকল্পের জন্য পরিষেবা প্রদান করতে পারবে।
আফ্রিকার কেনিয়ায় চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি সিসিসিসি’র অধীনে সিআরবিসি নির্মিত ও পরিচালনা করা নাইরোবি এক্সপ্রেসওয়ে ১৪ মে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়। ফলে কেনিয়াত্তা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নাইরোবি শহরের কেন্দ্রস্থলে যাবার সময় ২ ঘন্টা থেকে ২০ মিনিট পর্যন্ত কমানো হয় এবং কার্যকরভাবে শহরের কেন্দ্রস্থলের যানজট উপশম করে, বিরাট স্থানীয় কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।
সম্প্রতি নেপালে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন সাইনোম্যাচের নির্মিত পোখরা বিমানবন্দর প্রকল্পের নির্মাণ এবং ইনস্টলেশন প্রকৌশল সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। আধুনিক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু হবার পর কার্যকরভাবে দেশটির পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে এবং দেশটির বিমান চলাচল উন্নয়ন হবে।
চলতি বছর কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান বিদেশে ইতিবাচকভাবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নির্মাণ করে, স্থানীয় অবকাঠামোর মান উন্নত করে, স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য বহু কর্মসংস্থান সুযোগ সরবরাহ করে এবং স্থানীয় অর্থনৈতিক সমাজ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে।
উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে চীনা প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম
চলতি বছরের ২১ মার্চ বাংলাদেশের বৃহত্তম বিদ্যুত্ কেন্দ্র—পায়রা ২*৬৬০ মেগাওয়াট অতি-সুপারক্রিটিকাল কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। চায়না জেনারেল টেকনোলজি (গ্রুপ) হোল্ডিং, লিমিটেড বা জেনার্টেক এবং বাংলাদেশের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার কোম্পানির যৌথ বিনিয়োগে প্রকল্পটি প্রথম চীনা প্রতিষ্ঠান পিপিপি রূপে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও পরিচালনা বিদ্যুত্ প্রকল্প। কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম উভয়ই চীনা প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা। প্রকল্পে ব্যবহৃত আল্ট্রা সুপারক্রিটিকাল প্রযুক্তির কারণে বিদ্যুত্ কেন্দ্রের প্রধান নিঃসরণের পরিমাণ বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এবং বাংলাদেশের স্থানীয় মানদণ্ডের চেয়ে অনেক কম। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৩তম আল্ট্রা সুপারক্রিটিকাল প্রযুক্তি ব্যবহারকারী দেশে পরিণত হয় এবং দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে সারা দেশে বিদ্যুত্ চলাচল বাস্তবায়ন করতে নেতৃত্ব নেয়। “প্রথম সারা দেশে বিদ্যুত্ চলাচল বাস্তবায়িত দক্ষিণ এশীয় দেশ”—অনেক বাঙ্গালি এ কথা উল্লেখ করতে অতিরিক্ত খুশী হয়। প্রকল্পটি সার্বিকভাবে চালু হবার পর প্রতিবছর দেশটির জন্য ৮৫৮ কোটি ডিগ্রী পরিচ্ছন্ন শক্তি সরবরাহ করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে এতদঞ্চলে উদ্বেগজনক বিদ্যুত্ সরবরাহ পরিস্থিতি প্রশমন করার পাশাপাশি কার্যকরভাবে বাংলাদেশের জ্বালানী কাঠামো উন্নত করবে।
(প্রেমা/এনাম)