অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে বাংলাদেশের সিলেট ও সুনামগঞ্জ। সিলেট নগরীসহ জেলার ৮০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা এখনো পানির নিচে। ঘরবাড়ি, হাটবাজার, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, বিমানবন্দর, রেলস্টেশন সবকিছু পানিতে তলিয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎ সরবারহ, টেলিফোন নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সেবা পর্যন্ত। সব মিলিয়ে এক অভাবিত পরিস্থিতি।
এ দু'জেলায় ৯০ হাজার মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে ২২ হাজারের বেশি গবাদি পশু। আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষে-গবাদিপশুতে একাকার।
বন্যার ভয়াবহতা মোকাবেলায় প্রশাসনের সঙ্গে মাঠে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনীকে। তাদের সঙ্গে রয়েছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড। কিন্তু প্রয়োজনীয় নৌকা ও জলযানের অভাবে পানিবন্দি বহু মানুষের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। তাদের উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা যাচ্ছে না। তাদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না ত্রাণসামগ্রী। এর ফলে খাদ্য ও পানীয় জলের প্রবল সংকটে বন্যা উপদ্রুত জনপদের মানুষ। আগামী কয়েকদিনে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের আশা নেই এ অঞ্চলের দুর্গত মানুষের।
সিলেট ও সুনামগঞ্জে প্রবল বন্যার মধ্যেই বন্যাকবলিত হয়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলের আরও ৯ জেলা। ভারতে আসামে প্রবল বৃষ্টি ও উজানের ঢলের কারণে প্লাবিত হয়েছে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, নেত্রকোনা, লালমনিরহাট, নীলফামারি ও রংপুরের নিম্নাঞ্চল।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও গঙ্গা অববাহিকায় ভারী বৃষ্টির কারণে আগামী দু’একদিনের মধ্যে পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চল বন্যা কবলিত হতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, এবার যে বড় আকারের বন্যা হবে তা আগে থেকেই তারা জানতেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এবারের বন্যা বড় হবে তা তারা আগেই জানিয়েছেন এবং বন্যা মোকাবেলায় সব রকমের প্রস্তুতি রয়েছে।
বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোলমডেল- সরকারের তরফে এমন একটা আপ্তবাক্য গত বেশ ক’বছর ধরেই শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে সবসময় এর মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সিলেট-সুনামগঞ্জে এবারের বন্যায় দুর্গত মানুষকে উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় নৌকা কিংবা অন্য জলযান পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বন্যাপ্রবণ একটি এলাকার জেলা প্রশাসকের কাছে উদ্ধার ও ত্রাণতৎপরতা চালানোর মতো নৌযান থাকবে না- এটা কোনো প্রকার পূর্বপ্রস্তুতির নমুনা হতে পারে না।
এ ছাড়া সরকার যদি আগেই জানতো এবার বন্যা বড় আকারে হবে তবে জনসাধারণকে আগে থেকে সতর্ক করা হলো না কেন? এলাকার সচেতন মহল বলছেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে সচেতন করা হলে সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষকে এতবড় দুর্যোগে পড়তে হতো না- তারা প্রস্তুতি নিতে পারতেন।
এদিকে, সিলেট-সুনামগঞ্জে এবার দ্বিতীয় দফা এ বন্যার পর থেকে বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশের উজানে ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতরের কারণেই স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যার সৃষ্টি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন চেরাপুঞ্জির অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতই ভয়াবহ এ বন্যার একমাত্র কারণ নয়।
এ কথা ঠিক যে গত শুক্রবার সকাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী তিন দিনে চেরাপুঞ্জিতে আড়াই হাজার মিলিলিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে- যা গত ১২২ বছরের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। কিন্তু ১৯৮৮, ১৯৯৮ কিংবা ২০০৪ সালের গড় বৃষ্টিপাতকে এখনো ছাড়াতে পারেনি চলতি বছরের বৃষ্টিপাত। তবে বন্যার পানির উচ্চতা ও বন্যার ভয়াবহতা ছাড়িয়ে গেছে সব রেকর্ড।
তাহলে কেন এমনটা হলো? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত তিনটি কারণে কয়েক যুগের মধ্যে বড় এ বন্যা হয়েছে সিলেট ও সুনামগঞ্জে।
এক. নদনদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা হ্রাস।
দুই. হাওরে অপরিকল্পিত বাধ, রাস্তা ও স্লুইসগেট নির্মাণ।
তিন. নির্বিচারে পাহাড়ি টিলা ধ্বংস।
সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যার পানি নামার প্রধান দুটি নদী সুরমা-কুশিয়ারা। দুই শহরেই সুরমা নদীতে ময়লা আবর্জনা ফেলে স্বাভাবিক জলপ্রবাহ বিঘ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া নদী দুটির তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা কমে গেছে। হাওরে পরিবেশের কথা চিন্তা না করে বাধ-রাস্তাসহ নানা রকম উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে স্বাভাবিক পানির প্রবাহ আটকে দেওয়া হয়েছে। আর পাহাড়ি টিলা বৃষ্টি ও বন্যার অনেকখানি পানি শোষণ করে। কিন্তু নির্বিচার ধ্বংস করা হয়েছে ওই সব টিলা।
বন্যার হাত থেকে বাঁচতে বিশেষজ্ঞরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।
এক. সুরমা-কুশিয়ারাসহ নদ-নদীগুলো খনন করে নাব্যতা বাড়ানো।
দুই. সিলেট নগরের ভিতরে প্রবাহিত ছড়াগুলো খনন করে পানিপ্রবাহ বাড়ানো।
তিন. বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড় জলাধার খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ। এবং
চার. হাওরে অপরিকল্পিত কোনো বাধ, স্থাপনা নির্মাণ না করা।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে সরকার ভবিষ্যতে এমন অভাবিত দুর্যোগ থেকে মানুষের জানমাল রক্ষা করবে বলে দেশের মানুষে প্রত্যাশা।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।