প্রত্নতাত্ত্বিক সহযোগিতা চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব অব্যাহত রেখেছে
2022-06-14 17:00:31

‘বাংলাদেশের ইতিহাসের’ নতুন অধ্যায়ে ঐতিহাসিক প্রাচীন রাজধানী বিহারপুর, বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার পরিচিতিমূলক একটি অধ্যায় রয়েছে; যেখানে চীন-বাংলাদেশ যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিকঅনুসন্ধান ও গবেষণা কাজ করেছে। বিহারপুর বাংলাদেশের বিশিষ্ট বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং চীন-বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অগ্রদূত অতীশ দিপঙ্করের জন্মস্থান। চীন ও বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অতীশ দিপঙ্করের জীবনের ঐতিহাসিক স্থান।

 

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী এবং ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ বরাবর একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। যা প্রাচীন ‘দক্ষিণ রেশমপথের’ অবিচ্ছেদ্য অংশ। চীন ও বাংলাদেশের বিনিময়ের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। পূর্ব চিন রাজবংশের ফাসিয়ান, থাং রাজবংশের পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এবং অন্যান্য বিশিষ্ট সন্ন্যাসীরা বাংলাদেশে সফর করেছেন।

মিং রাজবংশের পর দু’দেশের মধ্যে বিনিময় আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। চীনের বৈদেশিক বিনিময়ের লিখিত রেকর্ডে প্রায়শই উল্লেখিত ‘Bangala’ এবং ‘Bangela’ বর্তমান বাংলাদেশকে নির্দেশ করে। মিং রাজবংশের সরকার বাংলাদেশের চট্টগ্রামে একটি আনুষ্ঠানিক কারখানাও স্থাপন করেছিল, যা চেং হ্য-এর নৌবহরের ঘাঁটিতে পরিণত হয়।

 

প্রাচীন শহর বিহারপুর রাজধানী ঢাকার প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মুন্সিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত, গঙ্গা ও যমুনা নদীর সংযোগস্থলে অবস্থিত। এটি চান্দলা (Candala), বর্মণ (Varman) এবং সিনার (Sena) তিনটি রাজবংশের রাজধানী এবং একইসঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মগুরু আতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান।

১০৪০ সালে ৫৯ বছর বয়সে অতিশা (অতীশ দীপঙ্কর) তুষার-ঢাকা পাহাড়ের উপর আরোহণ করেছিলেন, তাকে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য তিব্বতে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং  তার মৃত্যুর পর লাসার কাছে নিয়েথাং মন্দিরে সমাহিত করা হয়। ১৯৭৮ সালে অতীশ দিপঙ্করের দেহাবশেষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং তা এখন ঢাকার ধর্মরাজিকা বৌদ্ধমন্দিরে (Dharmarajika Buddhist Monastery) সংরক্ষণ করা হয়েছে। ২০১৭ সালে চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী বিনিময় বছরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে, অতীশ দিপঙ্কর মেমোরিয়াল হল আনুষ্ঠানিকভাবে নটেশ্বর সাইটের কাছে সম্পন্ন করা হয়। অতীশ দিপঙ্করের গল্প চীন-বাংলাদেশের বন্ধুত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

 

অতীশ দিপঙ্করের একজন তিব্বতি শিষ্য নাটসো চিত্রেচেঞ্জওয়া একবার তাঁর গুরুর বাসস্থানকে এভাবে বর্ণনা করেন: “পূর্ব সহোর্শ মহান এলাকায় একটি বড় শহর অবস্থিত, এর নাম বিহারপুর। শহরে রয়েছে গ্রেট কিংস প্যালেস, প্রাসাদটি চমত্কার ও প্রশস্ত।”

দীর্ঘদিন ধরে প্রাচীন শহর বিহারপুরে বৌদ্ধ ও হিন্দু পাথরের খোদাই, ইটের খোদাই ও তামার সমুদ্রসহ বিভিন্ন মূল্যবান সাংস্কৃতিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। স্থানীয় গ্রামবাসীরা যখন পুকুর ও বাড়ির ভিত্তি খনন করেন, তখন তারা প্রায়ই প্রাচীন ইটের দেয়াল এবং অন্যান্য পুরাকীর্তি খুঁজে পেতেন।

 

২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রাচীন শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ শুরু করে এবং প্রাচীন ইটের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়, কিন্তু তহবিল এবং প্রযুক্তির অভাবে খননকাজ খুব বেশিদূর আগায় নি। বিহারপুর ও অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান এবং চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আশা করে যে চীন থেকে সহায়তা পাওয়া যাবে। চীন সরকার ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছে এবং এটি চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশের মধ্যে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক সহযোগিতা হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে চীনা দূতাবাসের অধীনে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীনের হুনান প্রাদেশিক পুরাকীর্তি গবেষণাদল ছয়বার প্রাচীন শহর বিহারপুরের নটেশ্বর ঐতিহ্য সাইটকে বড় আকারের জরিপ ও খননকাজ করে। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন এলাকা ৬ হাজার বর্গ মিটারের বেশি। এতে উল্লেখযোগ্য ফলাফলও অর্জিত হয়।

“গঙ্গার বালিতে প্রথম কোদাল, প্রথম খনন” সহযোগিতার শুরুতে চীন ও বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক দলের মধ্যে ধারণাগত মতভেদ ছিল।

বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিকরা মূলত ইউরোপের প্রচলিত খননপদ্ধতি ব্যবহার করত, গভীরতা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে ঐতিহ্যিক রেকর্ড করার ওপর জোর দেয়। চীনে দীর্ঘদিনের অনুশীলন থেকে স্ট্র্যাটিগ্রাফিতে খুব দক্ষ হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে স্ট্রাটিগ্রাফিক বিচার এবং পৃথিবীর সাইটগুলি অনুসন্ধানের অনেক অভিজ্ঞতা আছে। চীনা পক্ষ ধৈর্যের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং চীনের পদ্ধতির সুবিধাগুলি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে। অবশেষে বাংলাদেশ দলের সমর্থন লাভ করে চীনা গবেষকদল।

 

নটেশ্বর সাইটের ঐতিহ্যের প্রথম পর্যায় হলো একটি মহায়ানা বৌদ্ধ মন্দির (Mahayana Buddhist temple)। মন্দিরের প্রান্তে অবস্থিত এবং বেশ কয়েকটি সন্ন্যাসীর ঘর ও বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হওয়ার ক্যান্টিন ভবন, বাথরুম ও ড্রেন। ভবনগুলি অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর দিকে নির্মিত হয়েছিল।

দ্বিতীয় পর্যায়ের সাইট একটি ‘ক্রস-আকৃতির কেন্দ্রীয় মন্দির’, যা ‘দাতুরা’ স্থাপত্য (Datura architecture) নামেও পরিচিত। এটি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। এই বৃহত্ আকারের ভিন্ন ফংশনসহ বৌদ্ধমন্দির সাহিত্যে রাজধানী শহরের সঙ্গে মেলে, একটি রহস্যময় প্রাচীন শহর যা দীর্ঘকাল ধরে সমাহিত হয়ে রয়েছে।

 

নটেশ্বর সাইটে সংরক্ষিত দু’টি যুগের স্থাপত্যের ঐতিহ্য দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধ স্থাপত্যের পরিবর্তন সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য দেয়। সাইটে প্রচুর পরিমাণ মাটির বাসন আবিষ্কার করা হয়েছে। এতে একটি প্রাথমিক মাটির বাসন শিল্পের যুগের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা বাংলাদেশের এক্ষেত্রে শূন্যতা পূরণ করে। এ ছাড়াও এতে প্রচুর চীনা চীনামাটির টুকরা পাওয়া গেছে, এর মধ্যে রয়েছে থাং রাজবংশ থেকে ছিং রাজবংশের সাদা চীনামাটির বাসন, নীল-সাদা চীনামাটির বাসন এবং অন্যান্য ধরণ, যা চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘ ইতিহাসে ঘনিষ্ঠ বিনিময়কে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।

এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার বাংলাদেশে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং ২০টিরও বেশি মিডিয়া প্রত্নতাত্ত্বিক খনন নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। নতুন সংস্করণের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’-এ  চীন-বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক দলের লিখিত ‘বিহারপুর’ অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত রয়ছে, যা মানবিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের অত্যাধুনিক ফলাফল হয়ে উঠেছে। চীনা ভাষা ও ইংরেজি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতিবেদন ‘নটেশ্বর’ বইটি দু’দেশে একইসাথে প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রকল্প চীনের সামাজিক ও বিজ্ঞান একাডেমির ২০১৯ সালের বিদেশি প্রত্নতাত্ত্বিকদের নতুন আবিষ্কার পুরস্কারও জয় করেছে।

নটেশ্বর সাইটের আয়তন অনেক বড় এবং এর শক্তিশালী দৃশ্য ও পর্যটন উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে চীন ও বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বিভাগ স্থানীয় জনগণের জীবন-জীবিকা ও মঙ্গলের লক্ষ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান পার্ক নির্মাণের সক্রিয় পরিকল্পনা করছে; যা চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের আরেকটি প্রতীক।

 

বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে একটি উপ-ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু রয়েছে, যা আর্দ্র, গরম, বৃষ্টিবহুল। তা ছাড়া প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান শহর থেকে অনেক দূরে, পানি ও বিদ্যুতের লাইনগুলি পুরানো এবং প্রায়শই বন্ধ থাকে। প্রত্নত্ত্বাতিক দলের সদস্যদের দীর্ঘমেয়াদী খননের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা কষ্ট সহ্য করতে পারে, তবুও তারা জীবনে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়।

বাংলাদেশে শুকনো মৌসুম ও বর্ষা মৌসুম আছে এবং সাইটে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ শুধুমাত্র শুকনো মৌসুমে করা যায়। এই সময়টি খুবই মূল্যবান। খাওয়া ও ঘুমের পাশাপাশি প্রত্নতাত্ত্বিকরা তাদের কাজ করার জন্য প্রতিদিন ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সাইটে কাজ করেছেন। এই কঠিন অবস্থায় প্রতিটি পরিকল্পনা সময় অনুসারে সম্পন্ন করা হয়। এই কাজের মনোভাব বাংলাদেশী দলের সদস্যদের সম্মান অর্জন করেছে।

গত কয়েক বছরে চীনা প্রত্নতাত্ত্বিক দল এবং তাদের বাংলাদেশী সহকর্মীরা পরিচিত হয়েছে এবং কাজের মাধ্যমে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। নটেশ্বরের ছোট্ট গ্রামটিও চীনা প্রত্নতাত্ত্বিকদের কর্মজীবন ও জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।