‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’- শিরোনামে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের জন্য বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট ৯ জুন সংসদে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি বাংলাদেশের ৫১তম বাজেট। আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের চতুর্থ বাজেট এবং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের উত্থাপন করা চতুর্থ বাজেট এটি।
এবারের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় তা ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেশি। আর এটি সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৮৪ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা বেশি।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে কর বাবদ আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। আর কর বহির্ভুত আয় ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। সবমিলিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার-যার সিংহভাগই আসবে ব্যাংক খাত থেকে। পাশাপাশি বৈদেশিক উৎস থেকে নেওয়া হবে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা ঋণ।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় ৬টি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো:
১. মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা।
২. অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানো।
৩. বিদেশি সহায়তা বাড়িয়ে অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন।
৪. স্বাস্থ্য ও শিল্পখাতের প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন।
৫. মূল্যসংযোজন করের পরিমাণ ও ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা বাড়ানো।
৬. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল রাখা।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে বক্তৃতায় সমস্যাগুলো চিহ্নিত করলেও তার সমাধানে যথাযথ নির্দেশনা দিতে পারেননি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।
অর্থমন্ত্রীর বিশাল বাজেটের মধ্যে সিংহভাগ অর্থাৎ ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকাই অনুন্নয়ন ব্যয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, মঞ্জুরি, ভর্তুকি ও দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে চলে যাবে রাজস্বের প্রায় পুরো অর্থ। এর মধ্যে সুদ বাবত ১৯.২ শতাংশ, বেতন_ভাতা বাবদ ১৭.৭ শতাংশ, ভর্তুকী প্রণোদনা বাবদ ১৭.২ শতাংশ আর মঞ্জুরি সহায়তা বাবদ রাখা হয়েছে ১৬.১ শতংশ। বাজেটের মাত্র ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য।
শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়। আগামী জাতীয় বাজেট ১৪ শতাংশ বাড়লেও স্বাস্থ্যখাতে তা বেড়েছে ১২ শতাংশ। শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমাণ গত অর্থবছরে ছিল ১১.৯২ শতাংশ। এবার তা বেড়ে হয়েছে বাজেটের ১২.০১ শতাংশ। কিন্তু শিক্ষা বাজেট মোট বাজেটের ২০ শতাংশ এবং জিডিপির ৬ শতাংশ হওয়া দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষা বাজেট জিডিপির মাত্র ৩ শতাংশ।
অন্যদিকে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বেড়েছে তুলনামূলকভাবে বেশি। গতবাররে মতোই স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের চেয়ে বেশি। এবার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ যেখানে ৫.৪০ শতাংশ, সেখানে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ৫.৯০ শতাংশ। সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ বরাবরের মতোই এক শতাংশের নিচে। এরকম অনেক খাতেই বরাদ্দে সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়নি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
করোনা মহামারির পর মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা সাধারণ মানুষ আশা করেছিল বাজেটে তাদের জন্য স্বস্তির কিছু থাকবে। কিন্তু দৃশ্যত বাজেটে মধ্যবিত্ত আর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য স্বস্তির কিছু রাখেননি অর্থমন্ত্রী।
বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। যদি ব্যবসায়ীদের করপোরেট করহার আরও কমানো হয়েছে। এবারও আড়াই শতাংশ করে তৃতীয় বারের মতো কমেছে করপোরেট করহার। বেতনের বাইরে করমুক্ত ভাতা ৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ লাখ টাকা করা হয়েছে।
বাজেটের সবচেয়ে ‘অসংবেদনশীল’ অংশ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া। করোনা মহামারির পরবর্তী সময়ে যেটা জরুরি ছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। পেনশন ব্যতিত সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ৩ হাজার কোটি টাকা কমেছে। ওএমএসের ১০ টাকা কেজির চাল ১৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এবারের বাজেটে সবচেয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে অর্থমন্ত্রীর নামমাত্র কর দিয়ে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার সুযোগ রাখা। একে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক কোনো দিক দিয়েই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। এতে এমন কিছু অর্থ দেশে আসবে বলে মনে করেন না তারা। এমনকি ব্যবসায়ী সমাজও এর বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন, এতে সৎ ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হবেন।
শুক্রবার রাজধানীর ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে কালো টাকা সাদা করার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ এমন সুযোগ দিয়ে লাভবান হয়েছে। তবে প্রতিবেশি ভারতে একাধিকবার এমন উদ্যোগ নিলেও তা খুব একটা কার্যকর হয়নি।
এ ছাড়া বাজেটে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন আর মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে রাখার বিষয়টি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এ অবস্থায় জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট পাশের আগে এ বিষয়গুলোর দিকে অর্থমন্ত্রী নজর দেবেন বলে প্রত্যাশা দেশের মানুষে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।