স্বপ্নের পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় বাংলাদেশের মানুষ। আগামী ২৫ জুন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে পদ্মা সেতু। সেতুর দু’পারে সেই ‘সুপার গর্জিয়াস’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করবেন সারাদেশের মানুষ। সাক্ষী হবেন এক অতুল গৌরবের।
২৫ জুন সকাল ১০টায় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন মন্ত্রিসভার সদস্য, রাজনীতিক, চীন ও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকসহ দেশবিদেশের আমন্ত্রিত অতিথিরা।
সেখানে সুধী সমাবেশ শেষে গাড়িতে করে প্রথমবারের মতো ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ, দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু পাড়ি দেবেন তিনি। এর মধ্যে দিয়ে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা সরাসরি যুক্ত হবে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে।
শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী উন্মোচন করবেন আরেকটি উদ্বোধনী ফলক। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ৪০ ফুট উঁচু দুটি ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে- যাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি রয়েছে। পাশে রয়েছে নামফলক, ফোয়ারা ও ইলিশের ভাস্কর্য।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক আয়োজন থাকবে। সন্ধ্যায় থাকবে আতশবাজি ও লেজার শো। পদ্মা সেতুর সেই জমকালো উদ্বোধন দেশের ৬৪টি জেলায় প্রদর্শনের ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। উদ্বোধন উপলক্ষে মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও ঢাকা জেলায় থাকবে বিশেষ আয়োজন। রাজধানীর হাতিরঝিলে থাকবে আতশবাজির বর্ণিল ছটা আর লেজার শো।
সবকিছু মিলিয়ে সরকার পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে বাংলাদেশের একটা বড় অর্জন হিসেবে- শুধু দেশে নয়, বিদেশের কাছেও তুলে ধরতে চাইছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম একে ‘সুপার গর্জিয়াস’ উদ্বোধনী হিসেবে অভিহিত করছেন।
দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। ওই পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসী পদক্ষেপ নেন এবং সেটা বাস্তবায়ন করেন। সঙ্গত কারণে শেখ হাসিনার সরকার এ বিরাট সাফল্যের জন্য গৌরব দাবি করতে পারে এবং এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের এ গৌরবের অংশীদার বন্ধুরাষ্ট্র চীন। মূল সেতু নির্মাণ এবং নদীশাসনসহ পদ্মা সেতুর বিভিন্ন ক্ষেত্রে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে চীনের বিভিন্ন খ্যাতনামা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। মূল সেতু নির্মাণ করেছে চীনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লি.।
মূল সেতু নির্মাণে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ১২ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকার চুক্তি হয়। মে পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯৯ শতাংশ।
এরই মধ্যে গত ৪ জুন পদ্মা সেতুতে প্রথম সড়কবাতি জ্বলে। এখন সেতুতে যান চলাচলের জন্য সাইন-সংকেত ও পথ নির্দেশ দেওয়ার কাজ চলছে। পাশাপাশি চলছে সেতুতে কংক্রিটের দেয়ালের ওপর স্টিলের রেলিং লাগানো কাজ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জাহাজে করে রেলিং আসতে বিলম্ব হওয়ায় এ কাজটি এখনো শেষ হয়নি। তবে ১৫ জুনের মধ্যে অর্থাৎ উদ্বোধনের নির্ধারিত সময়ের ১০ দিন আগেই বাকি এক শতাংশ কাজ সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন সেতু সংশ্লিষ্টরা।
নদী শাসনের গুরুত্বপূর্ণ কাজটিও করেছে চীনের আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। এ কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকার চুক্তি হয়। মে মাস পর্যন্ত তাদের পরিশোধ করা হয়েছে ৭ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। আর নদী শাসনের কাজ হয়েছে ৯৩ শতাংশ।
এর বাইরে সড়ক সংযোগ ও টোলপ্লাজা নির্মাণে দেড় হাজার কোটি, ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে ৪ হাজার ৩৪২ কোটি এবং নির্মাণ কাজ তদারকে পরামর্শক ও নিরাপত্তা কাজে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে এ যাবত ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। আর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
এদিকে, পদ্মা সেতু শুধু যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে তাই নয়। এটি দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে- বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তাই কেবল যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সীমাবদ্ধ না রেখে একে ঘিরে ইকোনমিক করিডোর গড়ে তোলার পরামর্শ তাদের। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে প্রস্তাবিত ১৭টি ইকোনোমিক জোন ও শিল্প পার্ক গড়ে তুলতে পারলে, সেটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ ও কর্মসংস্থান তৈরিতে বড় অবদান রাখবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।