‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-চীনের উদ্যোগে বিশ্বের একটা বিশাল অংশের সবচেয়ে বেশি দেশ, সর্বাধিক জনসংখ্যাকে জড়িত করার এবং বিপুল বিনিয়োগের এক মহা-পরিকল্পনা। এটি একুশ শতকে বিশ্বের বৃহত্তম উন্নয়ন প্রকল্পও বটে। যেটি একদিকে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার মাধ্যমে চীনের সঙ্গে ইউরোপে সংযোগ সাধন করছে। অন্যদিকে এটি চীনের সঙ্গে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের মেলবন্ধন ঘটাবে। এর মূল লক্ষ্য আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ, বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে আদান-প্রদান এবং বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়ন। বাংলাদেশও এ প্রকল্পের অংশীদার।
২০১৩ সালে প্রথম চীন এ মহাপরিকল্পনার কথা প্রকাশ করে। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে দু’দেশ ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের আওতায় সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষর করে। তখন থেকে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এই উদ্যোগের অংশ। গত ৬ বছরে দু’দেশের অর্থ-বাণিজ্য, নীতি, অবকাঠামো, যোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা অব্যাহতভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে।
চীনের এ উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা যাই থাকুক না কেন এ থেকে বাংলাদেশের লাভটাই যে বেশি তাতে প্রায় কারোই সংশয় নেই। তবে গুরুত্বপূর্ণ এ উদ্যোগ থেকে বাংলাদেশ যাতে সর্বাধিক পরিমান লাভবান হতে পারে সে বিষয়ে প্রয়োজন ছিল একাডেমিক গবেষণার। কিন্তু এতদিন বিষয়টি নিয়ে গবেষণা পরিচালনার মতো কোনো সংস্থা বা সংগঠন ছিল না।
বিশেষ এ প্রয়োজনটিকে সামনে রেখেই বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ‘বেল্ট এন্ড রোড রিসার্চ সেন্টার’-বিআরআরসি। শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়টির আশুলিয়া ক্যম্পাসে রিসার্চ সেন্টারটির উদ্বোধন হয়। বাংলাদেশে এটিই প্রথম চীন-বিষয়ক থিংকট্যাঙ্ক।
বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় চীন ও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে এবং দু’দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একাডেমিক গবেষণার কাজ বা থিংকট্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করবে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত রিসার্চ সেন্টারটি।
বিআরআরসি’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আয়োজক ও অতিথিদের কথায় ছিল তারই প্রতিধ্বনি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ সরকারের সাবেক শিল্পমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ চায়না সিল্ক রোড ফোরামের চেয়ারম্যান দীলিপ বড়ুয়া বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের দূরদর্শিতার নিদর্শন হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। এটি চীনের দর্শন তবে সারাবিশ্বের জন্য উপকারী ও কার্যকরী একটি উদ্যোগ। এর মাধ্যমে সার্বিক যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হবে। তিনি ড্যাফোডিলে প্রতিষ্ঠিত রিসার্চ সেন্টারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ বলে অভিহিত করেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে চীনা দূতাবাসের কালচারাল অ্যান্ড এডুকেশনাল অ্যাফেয়ার্সের কাউন্সিলর লিওয়েন ইউয়ে বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। চীন বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এই রিসার্চ সেন্টার নতুন মাত্রা যোগ করবে। বেল্ট অ্যান্ড রোড বিষয়ক গবেষণা এই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।
অনুষ্ঠানে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটির উপাচার্য ড. মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, বিআরআরসি’র পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাসুম ইকবাল, চায়না মিডিয়া গ্রুপের বাংলা বিভাগের পরিচালক ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী, চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ, চীনের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং চায়নিজ পিপলস অ্যাসোসিয়েশন অফ ফ্রেন্ডশিপ উইথ ফরেইন কান্ট্রিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট চিয়াং চিয়াংসহ চীন ও বাংলাদেশের অনেক বিজ্ঞজন সশরীরে ও অনলাইনে যুক্ত থেকে বক্তব্য রাখেন। তাঁদের প্রত্যেকেই রিসার্চ সেন্টারটির বিষয়ে উচ্চ আশা পোষণ করেন।
আশা করা যায় ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির সদ্য প্রতিষ্ঠিত রিসার্চ সেন্টারটি বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বিষয়ে গবেষণা এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। এ আশা করার সঙ্গত কারণও রয়েছে।
প্রথমত: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনার ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের একটি নামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আশুলিয়ায় দেড়শো একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় এটি। গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি এরই মধ্যে সবার নজর কেড়েছে।
ডিআইইউতে প্রতিষ্ঠিত বেল্ট এন্ড রোড রিসার্চ সেন্টারটির রয়েছে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বোর্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে রয়েছে পাঁচ সদস্যের একটি উপদেষ্টা বোর্ড। চায়নিজ পিপলস অ্যাসোসিয়েশন ফর ফ্রেন্ডশিপ উইথ ফরেন কান্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট, সাবেক রাষ্ট্রদূত লিন সংতিয়ানের নেতৃত্বে রয়েছে দু’সদস্যের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বোর্ড।
অন্যদিকে ডিআইইউ’র ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস এন্ড এন্ট্রাপ্রেনারশিপের ডিন অধ্যাপক ড. মাসুম ইকবাল বিআরআরসি’র পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। তার নেতৃত্বে বিআরআরসিতে রয়েছে ১০ সদস্যের একটি তারুণ্যদীপ্ত টিম। তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশও স্পষ্ট। বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বিষয়ে একাডেমিক রিসার্চ, আন্তর্জাতিক বিনিময় ও ট্যালেন্ট ট্রেইনিংয়ের কর্মসূচি রয়েছে তাদের।
ডিআইইউ’র ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস এন্ড এন্ট্রাপ্রেনারশিপের পাঁচটি বিভাগের স্কলাররা যুক্ত থাকবেন এ কার্যক্রমে। থাকবেন চীনের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্কলাররা। এ বিষয়ে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় এবং চিয়াংসি পিপলস অ্যাসোসিয়েশন অফ ফ্রেন্ডশিপ উইথ ফরেইন কান্ট্রিসের মধ্যে একটি সমঝোতাস্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে।
সবকিছু মিলিয়ে আশা করা যায় ডিআইইউ’র বেল্ট এন্ড রোড রিসার্চ সেন্টার তাদের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যেতে পারবে- যা থেকে বাংলাদেশ উপকৃত হবে এবং যা চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কে এটি একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।