বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এতে সাধারণ ভোক্তারা পড়েছেন বিপাকে। এর প্রতিবাদে বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভ ও দাম নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। সরকার ও ব্যবসায়িক নেতাদেরকে- এই গণদাবি বিবেচনা করে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি উঠেছে। এরই মধ্যে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র বিভিন্ন পণ্য গুদামজাত করে সাধারণ মানুষের কষ্টে আগুন ধরিয়েছে।
বাংলাদেশে অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছেন ক্রেতারা। ক্রেতাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৫ শতাংশ প্রাক্কলনের প্রস্তাব করতে পারে সরকার- এমন খবরও বেরিয়েছে। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে দফায় দফায় বেড়েছে সয়াবিন তেলের দাম। যা এখন লিটারপ্রতি ১৯৮ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া ধীরে ধীরে বাড়ছে গম, পেঁয়াজ ও আটার দাম। ফলে বছর বছর বেড়েই চলেছে মূল্যস্ফীতি। অথচ দেশে করোনা মহামারির সময় মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের নিচে ছিল। কিন্তু এক বছর পর মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ছয় শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া এপ্রিল মাসের ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, ১০০ টাকার পণ্যে খরচ বেড়েছে ৬ টাকা ২৯ পয়সা। মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি দেশের মানুষের আয় বৃদ্ধির গতি তেমন নয়। ফলে আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন জনগণ। নতুন করে বাজেটে মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। যেভাবে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে তাতে ভারসাম্য ধরে রাখা কঠিন হবে বলে আশঙ্কা করেছে স্বয়ং বিবিএস।
এদিকে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী সম্প্রতি এক সাক্ষাত্কারে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের প্রতি অভিযোগ করে বলেছেন, আকাশে মেঘ দেখলেই তারা ঝড় ঘোষণা করেন। অর্থাৎ, পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। দেশের বিচ্ছিন্ন কয়েকটি স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে বিক্ষোভকারীরা বলেছেন- দফায় দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানো যাবে না, চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম কামাতে হবে এবং সড়কে যানজট ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে।
দেশে বছরের পর বছর ধরে ডাল, চিনি, মুড়ি, মাছ, মাংস, ব্রয়লার মুরগি, ফল, তামাক, দুগ্ধজাতীয় পণ্য এবং অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর দাম বেড়েছে।
খাদ্যের পাশাপাশি শহরাঞ্চলগুলোর বাড়িভাড়া, আসবাবপত্র, গৃহস্থালি, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন, শিক্ষা উপকরণ এবং বিবিধ সেবাখাতের মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। খাদ্য খাত, খাদ্যবহির্ভূত খাত ও সাধারণ খাতে মূল্যস্ফীতির হার চড়া।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসেও গ্রামের তুলনায় শহরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল কম। এপ্রিল মাসে গ্রামে যেখানে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ, সেখানে শহরে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সুতরাং শহরের থেকে মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। এপ্রিল মাসে মজুরি সূচক ছিল ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ, অথচ সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। ফলে আয়ের সঙ্গে ব্যয় মেলাতে পারছেন না ক্রেতারা।
মে মাসের শুরুতে ভারত থেকে গম আমদানি বন্ধের ঘোষণায় দেশে ব্যাপকভাবে আটার দাম বেড়ে যায়। পাশাপাশি গমের ওপর নির্ভরশীল বিভিন্ন পণ্য—বিশেষ করে দেশের বেকারি শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশে বার্ষিক ৬৫-৭০ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। এসব গম দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট, চানাচুর, পাস্তা, রুটি, পাউরুটি, দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হোটেলের বৈচিত্র্যময় নানা ধরনের খাবার এই গমের আটা দিয়ে তৈরি করা হয়। শহরায়নের কারণে বছর বছর এই চাহিদা বেড়েই চলেছিল। পাশাপাশি, সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া পাম ওয়েল এক্সপোর্ট বন্ধ করায় বিশ্ব তেলের বাজারে আগুন লেগে যায়। যার উত্তাপে বাংলাদেশে ভোজ্য তেল- সয়াবিনের সংকট দেখা দেয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে দেশীয় বাজার পর্যন্ত যে সমস্যা বিরাজ করছে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কষ্ট ভোগ করছে দেশের সাধারণ মানুষ। মহামারির সময় থেকেই শহরের মানুষদের গ্রামাঞ্চলে ফিরে যাবার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। দফায় দফায় সৃষ্ট এসব সমস্যা যদি সরকার মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় সাধারণ মানুষকেই তার কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।(তৌহিদ)