সম্প্রতি ইউরোপের ‘মর্ডান ডিপ্লোমেসি’ ওয়েবসাইট ‘বাংলাদেশে বিদ্যুৎ-এর সম্পূর্ণ কভারেজ বাস্তবায়নে চীন অবদান রেখেছে’ নামে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে যে, চীনা প্রতিষ্ঠানের নির্মিত বাংলাদেশের বৃহত্তম বিদ্যুত্ স্টেশন প্রকল্প-‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র’ আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুতের সম্পূর্ণ কাভারেজ সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পুরো দেশে বিদ্যুত্ চালু হওয়া প্রথম দেশ। আর প্রবন্ধে এই প্রকল্প বাংলাদেশের উন্নয়নে দীর্ঘস্থায়ী বিভিন্ন ইতিবাচক প্রভাবের উত্তম বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
চীন ও বাংলাদেশ ভালো বন্ধু, ভালো ভাই, ভালো প্রতিবেশী। আমরা সবসময় এভাবেই বলি। তাহলে আপনি কি লক্ষ্য করেছেন? আপনার পাশে, আপনার জীবনে, আপনার জেলা, শহরে চীনের মৈত্রীর প্রমাণ আছে কি? চীনের সহায়তার বিভিন্ন প্রকল্প আপনার জীবনে কোনো পরিবর্তন এনেছে কি? আসলে মৈত্রী শুধু মুখের নয়, বরং চীন সবসময় বাস্তব আচরণ দিয়ে প্রমাণ করছে- চীন হল বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য বন্ধু, আজকে আমরা এই বিষয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করবো।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুতের অভাব ছিল। যা অর্থনীতি ও সমাজ উন্নয়নে বাধা দিয়েছে। পায়রা বিদ্যুত্ প্রকল্প হল ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের আওতার গুরুত্বপূর্ণ একটি। প্রকল্প চালু হওয়ার পর স্থানীয় অর্থনীতি ও জনগণের জীবিকা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আসলে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যানের কল্যাণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অবকাঠামো, অর্থনীতি, জীবিকা ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে।
২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশ সফরকালে দু’দেশ ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের আওতায় সহযোগিতার স্মারকলিপি’ স্বাক্ষর করেছে। তখন থেকে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এই উদ্যোগে অংশ নেয়। এই পর্যন্ত ৬ বছরে দু’দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা অব্যাহতভাবে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি নীতি, অবকাঠামো, বাণিজ্য, অর্থ ও জনগণের মৈত্রী বাস্তবায়িত করা হয়েছে।
নীতিগত বিনিময় ক্ষেত্রে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশের নেতার সঙ্গে বার বার যোগাযোগের সময় উল্লেখ করেছিলেন যে, চীন ও বাংলাদেশ উভয়ে জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশ। দেশের অবস্থার অনেক মিল আছে, উন্নয়ন লক্ষ্যও একই। ‘সোনার বাংলার’ স্বপ্ন এবং চীনা জাতির মহান পুনরুত্থানের স্বপ্নের মধ্যেও মিল আছে। চীনের উত্থাপিত ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ দু’দেশের উভয় কল্যাণকর সহযোগিতার জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। যা দু’দেশের সহযোগিতার জন্য দিকনির্দেশনা দিয়েছে এবং নীতিগত ভিত্তি স্থাপন করেছে। প্রেসিডেন্ট বলেছেন যে, দু’দেশের উচিত বাণিজ্যিক বিনিময় সম্প্রসারণ করা, অবকাঠামো, জ্বালানি ও বিদ্যুত্, সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহন, তথ্য ও টেলিযোগাযোগ, কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প চালু করা।
বাংলাদেশের সুপ্রতিবেশী দেশ হিসেবে চীন সবসময় বাস্তব আচরণের মাধ্যমে নিজের প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে, নিজেকে বাংলাদেশের নির্ভোরযোগ্য বন্ধু ও অংশীদারি হিসেবে প্রমাণ করেছে। ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের আওতায়, পায়রা বিদ্যুত্ কেন্দ্র প্রকল্প পায়রা বন্দর উন্নয়নে নতুন শক্তি যোগাবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ডিজিটাল প্রকল্প ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাহায্য করছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের অবকাঠামোর অনেক উন্নত হয়েছে।
বাণিজ্যিক খাতে, ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্য চীনে রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে। চীনের বিশাল বাজার এবং সুবিধাজনক নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানি অনেক বেড়েছে। গত বছর দু’দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। যা ইতিহাসে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে চীনের পুঁজি বিনিয়োগের পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে, চীনা শিল্প-প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বাজার নিয়ে খুব আশাবাদী।
অর্থের দিক থেকে, চীনের আর্থিক সহায়তার কোনো অযৌক্তিক শর্ত নেই। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জি মিং সম্প্রতি বাংলাদেশের মিডিয়াতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন একবার বলেছিলেন, উন্নয়ন অংশীদারির কাছ থেকে বাংলাদেশ আরও বেশি অর্থ চায়, তবে দুঃখের ব্যাপার হল, এসব অর্থ দিতে অনেক শর্ত পূরণ করতে হয়, এর ফলে অর্থ সংগ্রহ করা অনেক কঠিন হয়। তবে চীনের ঋণের কোনো পূর্বশর্ত নেই। বিশ্বের বৃহত্তম উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না, সচ্ছল আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করে। ‘দি ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিন জানায়, চীনের দেওয়া ঋণের গড়পড়তা সুদ শুধু মাত্র ১.২৩ শতাংশ। ঋণ পরিশোধের সময় ৩১ বছর, আর অতিরিক্ত ৮ বছর সময় নেওয়া যেতে পারে। চীন কখনই শুধু নিজের স্বার্থ বিবেচনা করে না, বরং বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করে, যাতে যৌথ উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা যায়।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর কথা অনুযায়ী বর্তমানে চীন ও বাংলাদেশ উভয় উন্নয়ন ও পুনরুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। চীনা জাতির মহান পুনরুত্থানের চীনা স্বপ্ন এবং ‘সোনার বাংলাদেশের’ স্বপ্নের অনেক মিল আছে। চীন ও বাংলাদেশ বাস্তব সহযোগিতা সম্প্রসারণ করছে, দু’দেশের বিনিময় আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, মৈত্রী আরও মজবুত হচ্ছে। এর মাধ্যমে জনগণের মৈত্রী আরও দৃঢ় হয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারির শুরুতে বাংলাদেশ চীনের অবস্থা দেখে দ্রুত সাহায্য দিয়েছে, বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণ চিকিৎসাসামগ্রী সংগ্রহ করে চীনে পাঠিয়েছে। আর যখন বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের মহামারি দেখা দেয়, চীন তখন বাংলাদেশে দ্রুত চিকিত্সক বিশেষজ্ঞদল পাঠিয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম সনাক্ত রোগী দেখা দেয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ, আর জুন মাসে চীন বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়েছে। যা ছিল বাংলাদেশের একমাত্র বিদেশি চিকিত্সক বিশেষজ্ঞদল। এ ছাড়া আরও বিপুল পরিমাণ চিকিত্সা সামগ্রী ও টিকা দিয়েছে চীন। চীন বাংলাদেশকে মহামারি প্রতিরোধে যথাসাধ্য সহযোগিতা করেছে। এ থেকেও বোঝা যায়, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি বেশ দৃঢ়। বাংলাদেশ হলো দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সঙ্গে টিকা উত্পাদন সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরকারী একমাত্র দেশ। মহামারি আরও বাড়লে সবাই দেখবে যে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে চীনের প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম দিয়ে করোনাভাইরাসের টিকা উত্পাদন করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ সোনার বাংলার স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ হল চীন ও বাংলাদেশের সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র, যা সহযোগিতার অনেক সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের সোনার বাংলা স্বপ্ন হলো ২০৪১ সালের সময় উন্নত দেশের সারিতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যাবে। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের গতি অনেক দ্রুত, টাকার মান অনেক বছর ধরে ৬ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২৪০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর উত্থাপিত বিশ্ব উন্নয়নের আহ্বান বাংলাদেশের উন্নয়ন লক্ষ্যের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক অঞ্চল, এক পথ সহযোগিতার মাধ্যমে চীন ও বাংলাদেশ শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার জোরদার করতে পারে, অন্যদিকে জীবিকা ও পরিবেশ সংরক্ষণসহ নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতার সুযোগ অনেক। আমরা বিশ্বাস করি, চীন ও বাংলাদেশের সহযোগিতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, শুধু বাণিজ্য ও পুঁজি বিনিয়োগই নয়, বরং অবকাঠামো, মেধাস্বত্ব, সবুজ উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়বে। আমরা আশা করি, চীন ও বাংলাদেশের মৈত্রীর আরও নতুন পর্যায়ে উন্নত হবে।
(শুয়েই/তৌহিদ)