সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের গোয়েন্দা কমিটিতে ইউএফও সম্পর্কে একটি গণশুনানির আয়োজন করা হয়। মার্কিন কংগ্রেস ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো ইউএফও নিয়ে প্রকাশ্যে গণশুনানি আয়োজন করেছে। এই গণশুনানিতে কি কি বিষয় বলা হয়? এলিয়েন কি পৃথিবীতে আসছে? যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি কি ইউএফও’র সঙ্গে সম্পর্কিত? কেন চীন ও রাশিয়ার কথা উল্লেখ করা হলো শুনানিতে? হঠাত্ করে এবারের গণশুনানি আয়োজন করার উদ্দেশ্য কি? আজকের অনুষ্ঠানে এসব প্রশ্নের উত্তর জানাবো।
প্রতিনিধি পরিষদের গোয়েন্দা কমিটির অধীনে সন্ত্রাসবাদ, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এবং কাউন্টার প্রলিফারেশন সাবকমিটির উদ্যোগে এ দিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা-বিষয়ক মার্কিন উপ প্রতিরক্ষামন্ত্রী রোনাল্ড মুত্রি এবং মার্কিন নৌবাহিনীর গোয়েন্দা ব্যুরোর উপ প্রধান স্কোট ব্রেই শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।
গণশুনানিতে স্কোট ব্রেই ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে মার্কিন সামরিক পক্ষের পর্যবেক্ষণ করা কিছু আংশিক ‘অজানা এরিয়াল ঘটনা’ তুলে ধরেন। ৯০ মিনিটের এই শুনানি সরাসরি প্রচারিত হয়।
২০২১ সালে মার্কিন কংগ্রেসের কাছে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালকের কার্যালয়ের দাখিল করা এক রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ২০০৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মার্কিন সামরিক পক্ষ মোট ১৪৪টি ‘অজানা এরিয়াল ঘটনার’ রিপোর্ট করেছে। মুত্রি বলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন কার্যালয় গঠন করবে, যাতে এসব ইউএপি জানা যাবে।
শুনানিতে বহির্জাগতিক জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যের এই প্রশ্ন নিয়ে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিষয়ক মার্কিন উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রোনাল্ড মুত্রি সরাসরি উত্তর দেননি। তিনি বলেন, মার্কিন সরকারের গবেষকরা বহির্জাগতিক জীবন খুঁজছেন। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য কিছু জিনিস গোপন করা নয়, তবে কী থাকতে পারে তা জানার চেষ্টা করা।
বিশ্বের অনেক ইউএফও দর্শক ‘উড়ন্ত সসার’ দেখেছেন- যা উল্কাপাতের মতো প্রাকৃতিক ঘটনা দেখে ভুল বোঝাবুঝির মতো বিষয়।
এই শুনানিতে প্রদর্শিত ভিডিওতে দেখা যায়, ইউএফও বাতাসের বিপরীত উচ্চতায় উড়তে পারে, স্থির থাকতে পারে বা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলতে পারে, এতে কোনও চালক দেখা যায়নি। এ বিষয়ে ব্রেই ও মুত্রি কোনও ব্যাখ্যা দেন নি।
সেদিনের শুনানিতে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান পার্টি উভয়ই মনে করে যে,ইউএফও সমস্যাটি ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ সাথে সম্পর্কিত, বিশেষত ‘অচেনা বায়বীয় ঘটনা’, যা মার্কিন সামরিক ঘাঁটি এবং উপকূলরেখার কাছে দেখা গিয়েছিল। কংগ্রেসের কোনো কোনো সদস্য বিশ্বাস করেন যে, এসব ইউএফও বিদেশের ওপর নজরদারি করা ড্রোন। ঘটনা সত্য হলে যুক্তরাষ্ট্রকে তা বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
এক কথায় বলা যায়, শুনানিতে এ সম্পর্কে খুব বেশি ব্যাখ্যা করা হয়নি; বরং কংগ্রেসের সদস্যরা ‘নিরাপত্তা হুমকি’ জল্পনাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
সিএনএনয়ের প্রতিবেদনে বলা হয় যে,মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা, গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং সামরিক কর্মীরা যারা ইউএফও ঘটনা গবেষণার কাজ করছেন,তাদের বৃহত্তর উদ্বেগের কারণ ‘পৃথিবীতে ভিনগ্রহের জীবন’ নয়, বরং ‘রাশিয়া বা চীনের মতো বিদেশি প্রতিপক্ষ’ মার্কিন আকাশে কিছু মোতায়েন করতে পারে, অতি উন্নত প্রযুক্তি, যা যুক্তরাষ্ট্র জানে না— এমন সব কথা বলেছে।
এই বিষয়ে সামরিক বিশেষজ্ঞ তু ওয়েন লোং বলেন,এসব ইউএফও চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা মূলত চীন ও রাশিয়ার বিমান হুমকি বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব লক্ষ্য রয়েছে। প্রথমত, নতুন অস্ত্র ও সরঞ্জাম বিকাশের জন্য জনমত তৈরি করা এবং মানবহীন বুদ্ধিমান নেটওয়ার্কের সুবিধার জন্য চেষ্টা করা। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন প্রয়োজন এবং এই ধরনের প্রচারের মাধ্যমে কংগ্রেস বিভিন্ন প্রকল্পে উচ্চ পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার অনুমতি দিতে পারে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র তার নতুন অস্ত্র ও সরঞ্জাম পরীক্ষার কিছু চিহ্ন গোপন করতে পারে।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘর্ষে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে নির্দেশনা প্রদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশ উপগ্রহ ব্যবহার করেছে এবং আমেরিকান মহাকাশ অনুসন্ধান কোম্পানি ‘স্টারলিংক’ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইউক্রেন অঞ্চলে পরিষেবা দিয়েছে ও টার্মিনাল সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘স্টারলিংক’ সিস্টেম ইউক্রেনীয় কমান্ড ও কন্ট্রোল সিস্টেমের সঙ্গে যোগাযোগে সহায়তা করেছে এবং রুশ সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণে ইউক্রেনীয় ড্রোনকে সহায়তা দিয়েছে। স্থানীয় সময় ১৯ মে রুশ মিডিয়া জানায় যে, একজন বন্দী ইউক্রেনীয় অফিসারের মতে, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী ইউক্রেনীয় জেনারেল স্টাফের সাথে যোগাযোগ করতে এবং তথ্য প্রেরণের জন্য আজভস্টাল স্টিল প্ল্যান্টে ‘স্টারলিংক’ সরঞ্জাম ব্যবহার করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র যখন সামরিক অভিযান চালায় এবং সংঘাত উস্কে দেয়, তখন তার স্যাটেলাইটগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। এখন মার্কিন সামরিক বাহিনী মহাকাশ খাতে আরও আর্থিক সহায়তা আশা করছে। তথাকথিত ইউএফও’র ঘটনা দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রতারণা করার মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং মহাকাশ যুদ্ধে আরও বেশি অস্ত্র ও সরঞ্জাম তৈরি করতে চায়।
ঝামেলার মুখোমুখি হলে ইউএফও’র ওপর দায় চাপানো পুরানো মার্কিন কৌশল। এভাবে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে সরানো যায়।
ইউএফও সম্পর্কে মার্কিন জনগণের জানতে পারে ১৯৪৭ সালে। সেই বছর, একজন পাইলট ওয়াশিংটনের মাউন্ট রেইনিয়ারের উপর দিয়ে সুপারসনিক গতিতে নয়টি ‘ডিশ’-এর মতো বস্তু উড়ে যেতে দেখেন। সেই প্রথমবার ইউএফও দেখা রেকর্ড করা হয় এবং সেই বছর যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়।
১৯৬৬ সালে, যখন স্নায়ুযুদ্ধ ব্যাপক আকার ধারণ করে, তখন যুক্তরাষ্ট্র একই বছরে একটি ইউএফও শুনানি আয়োজন করে। তারপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায় এবং মার্কিন মিডিয়া ইউএফও সম্পর্কে অনেক কম রিপোর্ট করেছিল।
২০২০ সালের এপ্রিলে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ‘জীবাণুনাশক ইনজেকশন’ মন্তব্যের জন্য কিছুটা ঝামেলায় পড়েন। এক মাস পর মার্কিন নৌবাহিনীর নিরাপত্তা কেন্দ্রে নৌবাহিনীর বিমান ও ইউএফও’র মধ্যে সংঘর্ষ সম্পর্কে ৮টি ‘বিপজ্জনক রিপোর্ট’ প্রকাশ করেছে।
আমেরিকান বিজ্ঞান ইতিহাসবিদ কেট ডরসি ২০২১ সালে ‘ফরেন পলিসির’ এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে, ‘ইউএফও’ ধারণাটি মূলত শীতল যুদ্ধের সময় দুই পক্ষের পারস্পরিক সন্দেহের ফসল। ২০২১ সালে এবং ১৯৪৭ সালে ইউএফও সম্পর্কে মার্কিন বক্তব্য কাকতালীয়ভাবে ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
বর্তমানে ইউরোপ পরিস্থিতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র যে বিপুল পরিমাণ সামরিক সহায়তা প্রদান করেছে, তা আমেরিকান অর্থনীতি এবং জনগণের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। এই সময় যুক্তরাষ্ট্র জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে দিতে এবং মার্কিন জনগণকে তাদের মনোযোগ পরিবর্তন করতে একটি ‘ইউএফও’ শুনানির আয়োজন করেছে।
লিলি/তৌহিদ