চীনা বাচ্চাদের শ্রম ক্লাস
2022-05-23 15:11:49

সম্প্রতি চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন প্রদেশের প্রাথমিক স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘শ্রম ক্লাস’ চালু হবে। এ ক্লাসের মাধ্যমে ঘরবাড়ি পরিষ্কারের কাজ, রান্নাবান্না ও মেশিন মেরামতসহ বিভিন্ন দক্ষতা শিখতে পারবে শিশুরা।

 

আসলে শ্রম ক্লাস ১৯৭০ ও ১৯৮০ সালের পরের প্রজন্মের চীনাদের জন্য পরিচিত ব্যাপার। তাদের ছোটবেলায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে শ্রম ক্লাস ছিল। তবে ২০০০ সালের পর এমন ক্লাস ধীরে ধীরে বাতিল করা হয়। আসলে, জীবনযাপনের জন্য বিভিন্ন ধরনের শ্রমে দক্ষতা অর্জন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বিশেষ করে মহামারীর কারণে অনেকেই আজকাল বাড়িতে বসে অফিসের কাজ করছেন। আগে ক্যান্টিন বা রেস্তোরাঁয় খাবার অর্ডার করে সেখানে বসেই খাওয়া যেত। তবে, মহামারীর কারণে যদি কোনো এলাকা লকডাউন হয়, তখন নিজে রান্না করার খুবই একটা বিকল্প নেই। এসময় বাড়িঘরও নিজেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সারাদিনে ঘরে থাকা লোকদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাই শ্রম ক্লাস পুনরায় শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের জীবনযাপনের দক্ষতা অর্জনে অনেক ইতিবাচক ভুমিকা পালন করবে। আজকের আসরে আমরা চীনের শ্রম ক্লাসের মূল বিষয় এবং চীনাদের দৃষ্টিতে শ্রম ক্লাসের ভুমিকা নিয়ে আলোচনা করবো।

 

 

শ্রম নিয়ে চীনের বিভিন্ন প্রজন্মের লোকদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন ভিন্ন। তবে বিভিন্ন কাজে দক্ষতা অর্জন নিজেদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন অনেকেই। ১৯৬০ সালের পর জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের জন্য শীতকালে উত্তর চীনের আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা ছিল। সেই সময় স্কুলের ক্লাসে হিটিং ব্যবস্থা ছিল না। তাই বাচ্চারা স্কুলে চুলা ও কয়লা পিণ্ড তৈরি শিখতো।

 

তখন তারা ফ্ল্যাটবেড ট্রাক দিয়ে কয়লার পাউডার ও মাটি নিয়ে আসতো। অল্প পানিতে কয়লা ও মাটি মিশিয়ে কেক বানানো হতো। মানে কয়লার কেক। তারপর সেগুলো সূর্যালোকে কয়েক দিন শুকানোর পর ক্লাসরুমের কাছাকাছি রুমে রেখে সেগুলো ব্যবহার করা হতো। তখন মাধ্যমিক স্কুলের শ্রম ক্লাস সংগীত ও চারুকলা ক্লাসের মতো সপ্তাহে একদিনই হতো; তবে তা বাচ্চাদের সবচেয়ে প্রিয় ক্লাসগুলোর অন্যতম ছিল।

 

শিক্ষকরা এ ক্লাসে বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা ও স্কিল শিখিয়ে দিতেন; যেমন, সোয়েটার বা ওড়না বানানো, কাগজ কাটা, শাকসবজি চাষ, ইত্যাদি। সাইকেল মেরামতও অতি গুরুত্বপূর্ণ এক দক্ষতা। অতীতে চীনা শিক্ষার্থীদের অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করতো। তবে সাইকেল সহজেই নষ্ট হয়; যেমন, চেইন পড়ে যাওয়া বা টায়ার ফেটে যাওয়া। তখন নিজের সাইকেল নিজেকেই মেরামত করতে হতো। তাই সাইকেল মেরামত করার দক্ষতা খুব কাজে লাগতো।

 

দক্ষিণ চীনের বাচ্চাদের জন্য ধান কাটা শ্রম ক্লাসের একটি বিষয় ছিল। ছোটবেলা থেকে হাতে কাস্তে নিয়ে ধান কাটা শেখে অনেক শিশু-কিশোর। ধানের শীষ থেকে কিভাবে দানা সংগ্রহ করতে হয়, সেটিও তাদের জানার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চেচিয়াং প্রদেশে চীনের সবচেয়ে বেশি ধানক্ষেত আছে। প্রতিবছরে কমপক্ষে তিনবার ফসল হয় সেসব ক্ষেতে। তখন বাচ্চারা কেবল নিজের পরিবারের ধান সংগ্রহে সাহায্য দিত না, বরং প্রতিবেশীদের বাড়িতেও কাজ করতো। সূর্যালোকের নিচে ধান শুকিয়ে নিতে সারাদিন লাগে। সূর্যাস্তের পর বাড়িতে ফিরলে দেখা যেত অনেকের চামড়া রোদে পুড়ে গেছে।

ধান কাটার পদ্ধতিও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে দাঁড়াতে হবে, ধানের গোছা কীভাবে ধরতে হবে, কীভাবে ধানের ধারালো পাতা থেকে নিজেদের হাত-পা রক্ষা করতে হবে—এমন অনেক জিনিসই তাদের শিখতে হবে। সাধারণত ক্লাসের ছেলেরা ধান কাটার কাজ করতো, মেয়েরা তাদের জন্য কিছু খাবার পাঠিয়ে দিতো।

শ্রম ক্লাসের মাধ্যমে টয়লেট মেরামত, বাতি ও কল পরিবর্তনসহ বিভিন্ন দক্ষতা অর্জন করতেন চীনারা। সেটি আসল জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রম ক্লাস না-থাকার কারণে আমরা খেয়াল করি যে, অনেক বড় শহরের শিশু-কিশোররা ঘরের কাজ সম্পর্কে কিছু জানে না। তারা বড় হলেও বাচ্চাদের মতো তাদের যত্ন নিতে হয়। রেস্তোরাঁ বা ক্যান্টিন না-থাকলে সময়মতো খাবার খাওয়া তাদের জন্যও মুশকিলের ব্যাপার। তাই এ সমস্যা সমাধানে চীনের বিদ্যালয়গুলোতে আবারও শ্রম ক্লাস চালু হতে যাচ্ছে।

আমি নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। আমার নানী একজন কাঠমিস্ত্রি। ছোটবেলায় আমার স্মৃতিতে তিনি নিয়মিত বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের কাঠ কাটতেন বা ডিজাইনের কাজ করতেন। শুনেছি বাবা-মার বিবাহের সময় বাড়িতে কয়েকটি আসবাবপত্র তিনিই ডিজাইন করে তৈরি করেছেন। যেমন, বিছানা, টেবিল ও বড় টয়লেট। এমন দৃশ্য কেবল ১৯৮০ সালের আগে সেই সময় দেখা যেতো, কারণ ১৯৭৮ সালের পর বৈদেশিক উন্মুক্তকরণের পর আসবাবপত্র সস্তা দামে পাওয়া যেতে শুরু করলো। তখন লোকেরা কষ্ট করে নিজেরা আসবাবপত্র তৈরি করা বাদ দিল।

আমার ছোটবেলায় শ্রম ক্লাস থেকে শিম, স্ট্রবেরি আর ফুল চাষসহ বিভিন্ন দক্ষতা শিখেছি। তা ছাড়া, প্রতি সপ্তাহে ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসরুম পরিষ্কার করার কাজ করতো। শিক্ষার্থীরা জানালা, টেবিল, কালো বোর্ড ইত্যাদি পরিষ্কার করতো। তুষার পরলে সবাই একসাথে রাস্তার তুষার ও বরফ পরিষ্কার করতো। যদিও কাজ করতে ক্লান্ত লাগতো, কিন্তু সেসব শিক্ষা আমাদের পরবর্তী জীবনে অনেক কাজে লেগেছে। অনেক মজার স্মৃতিও আছে আমাদের। তা ছাড়া, ছোটবেলায় বইয়ের বাইরে কিছু কাজ করা শিখলে আত্মবিশ্বাসও বাড়ে।

পিতামাতারা শুধু বাচ্চাদের লেখাপড়া নিয়ে, তাদের স্কোর নিয়ে চিন্তিত থাকবেন, এমনটা হওয়া উচিত নয়। তাদের উচিত বাচ্চাদের হাতে-কলমে অনেককিছু শেখানো; বিশেষ করে নিজের কাজটা নিজে করা শেখানো।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে: চীনা ছাত্রছাত্রীদের নতুন শ্রম ক্লাসে কী কী বিষয় থাকছে? সেটি মূলত কয়েকটি অংশ নিয়ে গঠিত। তাতে সাধারণ জীবনের বিভিন্ন শ্রমের কাজ, কৃষি খাতের শ্রম, এবং স্বেচ্ছাসেবক পরিষেবার শ্রম রয়েছে। যেমন, প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে রান্নাবান্নার কাজে শাকসবজি পরিষ্কার করা, তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে খাবার হিটিং করা, ডিম সিদ্ধ করা বা ডাম্পলিং সিদ্ধ করা ইত্যাদি কাজ শেখানো হবে এবং পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ডিম ভাজা, মাংসের সুপ রান্না করা, ইত্যাদি ডিশ রান্না করা শেখানো হবে। এভাবে মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা লাঞ্চ বা ডিনারের কয়েকটি ডিশ রান্না করা শিখে ফেলবে।

কৃষিকাজের বেলায় প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এক বা দুই ধরনের উদ্ভিদ বা পশু পালনের চেষ্টা করতে হবে শিক্ষার্থীদের। তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে শাকসবজি চাষ করা বা পাখি লালনপালন শেখানো হবে। পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ফল গাছ লাগানো বা ছাগল, খরগোশ, ইত্যাদির যত্ন নেনোয়া শেখানো হবে।

ঘরের কাজের মধ্যে বাচ্চাদের বয়সভেদে বিভিন্ন কাজ শেখানো হবে। যেমন, নিয়মিত ঘরের টেবিল ও মাটির ধুলো পরিষ্কার করা,  থালা-বাসন ধোয়া, নিজের কাপড়চোপড় ধোয়া, ভিন্ন ধরনের আবর্জনা ভাগ করা, ইত্যাদি। নিজেদের পড়াশোনার বই, খেলনা,  স্টেশনারি ও ব্যাগ গুছিয়ে রাখার শিক্ষাও দেওয়া হবে। সময়মতো টেবিলের জিনিস সুশৃঙ্খলভাবে রেখে দেওয়াও শিক্ষার্থীদের শেখানো হবে।

রান্নাবান্নায় পিতামাতাকে সাহায্য করা শেখানো হবে শিক্ষার্থীদের। ফলের খোসা ছাড়ানো বা শাকসবজি ও ফলের পুষ্টিকর উপাদান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবে তারা।

হস্তকর্মশিল্পের বিভিন্ন দিক সম্পর্কেও শেখানো হবে শিক্ষার্থীদের। কাগজ কাটা, মাটির ভাষ্কর্য বানানো আর বুননসহ বিভিন্ন বিষয় থাকে ক্লাসে। এসব ক্লাসের মাধ্যমে ঐতিহ্যিক হস্তকর্মশিল্প তৈরির প্রক্রিয়া তারা বুঝতে পারবে।

তা ছাড়া, আধুনিক পরিষেবা শিল্পের উন্নয়নের সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট কারিগরি প্রশিক্ষণও অতি প্রয়োজন। তাই মাল পরিবহন, ডাক বা তথ্য সম্প্রচারসহ বিভিন্ন খাতে ইন্টার্নশিপের সুযোগ তৈরিতে চেষ্টা করবে স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্বেচ্ছাসেবক শ্রমের মাধ্যমে অন্যদের সহায়তা দেওয়া যায়। ছুটিতে ক্যাম্পাসে বা আবাসিক কমিউনিটিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অন্যদের সেবা করাও ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি ভালো সুযোগ। এভাবে সামাজিক পরিষেবার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে তারা, সমাজের জন্য অবদান রাখার চেতনাও সৃষ্টি হবে তাদের মনে।

মোদ্দাকথা, শ্রমের কাজ শেখা একটি গর্বের ব্যাপার। শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্য নিজের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার। তাই বাচ্চাদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই শ্রমের কাজ করে সাফল্য অর্জনের অভ্যাস তৈরি করা অতি জরুরি। অলস হওয়া থেকে তাদের বাঁচাতে হবে এবং এভাবেই তারা দেশের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে পারবে।

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)