অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশ: উত্তরণে চাই সমন্বিত উদ্যোগ
2022-05-22 20:18:18

নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি থেকে বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে। করোনা মহামারিতেও মোটামুটি সচল ছিল দেশের অর্থনীতি। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকেই নিত্যপণ্যসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে বড় ধরনের মূল্যস্ফীতিতে পড়ে অর্থনীতি। এর সঙ্গে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এবং প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় দেখা দেয় ডলার সংকট। এর ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কায় অর্থনীতিবিদরা। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নানা পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। সরকারের তরফেও করণীয় নির্ধারণে সহসা এ বিষয়ে ঘোষণা আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

চলতি বছরের শুরু থেকেই দফায় দফায় বাড়তে থাকতে নিত্যপণ্যের দাম। ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানিসহ পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়ে। এতে দেশের বাজারেরও বেড়ে যায় নিত্যপণ্যসহ প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের দাম। বর্তামানে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল, লবনসহ সব নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি। বেড়েছে সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, পোশাক, খাতা, কলমের দাম। বেড়েছে বাসভাড়াসহ সার্বিক যাতায়াত ভাড়া। 

জরিপে দেখা গেছে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালে নিত্যপণ্য চাল, আটা, ডাল, তেলের মূল্য বেড়েছে ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। জানুয়ারিতে যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৮৬ শতাংশ ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬.১৭ শতাংশে। আর মার্চ ও এপ্রিলে তা ক্রমশ বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬.২৪ ও ৬.২৯ শতাংশ। 

বিবিএসের হিসেবে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় কম। ভারতে গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৭৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৩.৪ শতাংশ, নেপালে ৭.২৮ শতাংশ এবং গভীর অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ২৯.৮ শতাংশে। 

তবে অর্থনীতিবিদরা বিবিএসের নির্ধারিত মূল্যস্ফীতির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছেন। তাদের কারো কারো অভিমত দেশে মূল্যস্ফীতি প্রকৃতপক্ষে ১২ শতাংশের বেশি হতে পারে। 

এমনই একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ডলার সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় সারা বিশ্বে ডলারের দাম বেড়েছে। তার ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়ানোয় গত ২০ বছরের মধ্যে ডলারের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। 

গত মে থেকে চলতি মে পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার দরপতন হয়েছে ৩.৩৫ শতাংশ। ভারতীয় রুপিতে ৬.১১, পাকিস্তানি রুপিতে ২০.৭৪, চীনা ইউয়ানে ৪.৯৮, ইউরোতে ১৩.৬৯ এবং ব্রিটিশ পাউন্ডে ১২.২৪ শতাংশ দরপতন হয়েছে। অর্থাৎ বিষয়টি বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়। কিন্তু বিষয়টি দেশের আমদানি-রপ্তানিতে জটিলতা সৃষ্টি করছে যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। 

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ডলারের দাম বেধে দিয়েছে ৮৭.৫০ টাকা। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেই লেনদেন হচ্ছে ডলার প্রতি ৯০ টাকার ওপরে। আর খোলা বাজারে প্রতি ডলার ৯৬ থেকে ৯৭ টাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম বেঁধে দেওয়ার পরও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এবং খোলাবাজারে মূল্যের এতটা তারতম্য বাজারের চরম অস্থির অবস্থাকে প্রামাণ্য করে তোলে। 

পণ্যের অস্বাভাবিক এ মূলবৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ডলার সংকট কাটিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে নানা পরামর্শ আসছে অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে ।

তার বলছেন, মূল্যস্ফীতি উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তের কাছে বিরক্তিকর। কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত আর দরিদ্র মানুষের জন্য বড় সংকট। তাই নিম্নবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সুরক্ষা জরুরি। এ বিষয়টিকে আগামী বাজেটে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ তাদের। 

বাজেটে খাদ্য ও নগদ সহায়তার জন্য বাড়তি বরাদ্দ রাখার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। একইসঙ্গে যুবকর্মসংস্থানে জোর দেওয়া, করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখে উন্নীত করার কথা বলছেন তারা। মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে না নামা পর্যন্ত নগদ সহায়তা কার্যক্রম চালু রাখতে বলছেন তারা।  সর্বোপরী অভ্যন্তরীণ চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে বাজারের ওপর চাপ কমানোর কথাও আসছে অর্থনীতিবিদ ও সরকারি মহলে।

এদিকে, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে টান পড়ছে রিজার্ভে। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এ অর্থে সাড়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। কিন্তু  বিভিন্ন খাতে এরই মধ্যে ৮০০ কোটি ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে আমদানির পরিমাণ কমলেও আমদানি ব্যয় বেড়ছে ৪১ শতাংশ। রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে এ ব্যয় সংকুলান হচ্ছে না। মাসে ঘাটতি থাকছে ১০০ কোটি ডলার। এ অবস্থা চলতে থাকলে বছরের শেষ নাগাদ দেশের রিজার্ভ ৩ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমে আসবে। 

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে গাড়ি ও বিলাসপণ্য আমদানি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করার পরামর্শ অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের। সাময়িকভাবে বিদেশে বিনিয়োগও বন্ধ রাখার কথা বলছেন তারা। এ ছাড়া প্রবাসীদের রেমিটেন্সে প্রণোদনা আড়াই শতাংশ থেকে কিছু সময়ের জন্য ৫ শতাংশ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। 

সরকার দেশের অর্থনীতির এ কঠিন অবস্থা থেকে উত্তরণে উদ্যোগী হয়েছে। গত ১৯ মে মন্ত্রিসভা এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়িত্ব দিয়েছে। শিগগির এ বিষয়ে ঘোষণা আসার কথা রয়েছে সরকারের তরফে। ব্যবসায়ী মহলসহ গোটা জাতি এখন তাকিয়ে আছে সরকারের ঘোষণার দিকে। 

মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।