গত ১৩ মে ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড জানিয়েছে, দেশের খাদ্যনিরাপত্তা রক্ষায় তারা বিভিন্ন দেশে গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ভারতের গম রপ্তানি বন্ধের এ ঘোষণার পর বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ, আমদানিকারকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের আটা ও সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। তবে, বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করছে, কীভাবে বিকল্প উপায়ে গম আমদানি করা যায়।
ভারত সরকার গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলেও দুটি ক্ষেত্রে রপ্তানি হবে বলে জানা গেছে। যারা ইতোমধ্যে ঋণপত্র বা এলসি খুলেছে এবং খাদ্য ঘাটতিতে থাকা দেশের সরকারি অনুরোধে ভারত সরকার রপ্তানি বজায় রাখবে।
বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে মোট আমদানি করা গমের মধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে শতকরা ৪৫ ভাগ, ক্যানাডা থেকে ২৩ ভাগ এবং ভারত থেকে ১৭ ভাগ গম আমদানি করা হয়েছিল। বাকি ১৫ ভাগ গম আমদানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা ও অস্ট্রেলিয়াসহ আটটি দেশ থেকে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ভারত থেকে শতকরা ৬৩ ভাগ, ক্যানাডা থেকে ১৪ ভাগ আর অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা হয় ২৩ ভাগ৷
উল্লেখ্য ভারত তার উৎপাদিত গমের ৫০ শতাংশেরও বেশি গম এককভাবে রপ্তানি করে শুধু বাংলাদেশে। তাই, রপ্তানি বন্ধের এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধাক্কা।
বাংলাদেশ প্রতি বছর ১০ লাখ টন গম উৎপাদন করে। বাদবাকি অংশ তাকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে বার্ষিক ৬৫-৭০ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। এসব গম দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট, চানাচুর, পাস্তা, রুটি, পাউরুটি, দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হোটেলের বৈচিত্র্যময় নানা ধরনের খাবার এই গমের আটা দিয়ে তৈরি করা হয়। শহরায়নের কারণে বছর বছর এই চাহিদা বেড়েই চলেছিল।
শহর গ্রামের দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের মানুষ চা’র সঙ্গে বিস্কুট, পাউরুটি, রুটি, পরটা ইত্যাদি খাবার খেয়ে থাকে। তাই গম থেকে তৈরি এসব খাবারকে বলা যেতে পারে গরীব ও মধ্যবিত্তের খাবার।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের প্রধান গম দাতা দেশ ছিল ভারত। তার দামও ছিল কম। টনপ্রতি ২৫০-৩০০ ডলারে বাংলাদেশ এই বিপুল পরিমাণ গম কিনতে পারতো। পাশাপাশি, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা গমের দিকে নজর পড়ে। তবে তার দাম একেবারে দ্বিগণ। অর্থাৎ টনপ্রতি ৫২০-৫৩০ ডলার। দামের পাশাপাশি এর পরিবহন খরচও অনেক বেশি।
পাশাপাশি, সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া পাম ওয়েল এক্সপোর্ট বন্ধ করায় বিশ্ব তেলের বাজারে আগুন লেগে যায়। যার উত্তাপ বাংলাদেশে ভোজ্য তেল- সয়াবিনের সংকট দেখা দেয়।
কিন্তু ভারতের এই গম রপ্তানি বন্ধের কারণ কী? কারণ, ভারতে ‘হিট-ওয়েভ’ বা প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক উষ্ণতা দুর্যোগের কারণে গম উৎপাদনে সংকট দেখা দিয়েছে। পাকিস্তানেও একই বিপদ দেখা দিয়েছে। সার্বিক এক হিসেবে দেখা যায় হিট-ওয়েভের কারণে ভারতে ৫০% গম উৎপাদন হয় নি। তাই বাধ্য হয়ে দেশটি এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। গোটা পৃথিবীকে গম খাওয়ানোর ঘোষণা দিয়ে ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করে দেয়।
পাশাপাশি, বাংলাদেশে ভুট্টার উৎপাদনও এবার কম হয়েছে। আবহাওয়াজনিত কারণে বাংলাদেশে এ বছর গমের উৎপাদন কম হয়েছে বলে খবর বের হয়েছে।
এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্বাভাবিক ব্যাপার। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দুর্যোগে বিভিন্ন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে। তাই একটি দেশকে মৌলিক প্রয়োজনীয় দিকগুলোতে স্বনির্ভর হওয়া জরুরি। তার মধ্যে একটি হলো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। যেখানে বাংলাদেশের ৬৫ লাখ টন গমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সেখানে ৫৫ লাখ টন বাইরে থেকে কিনে আনার এই পরনির্ভরশীল মানসিকতাই মূলত আজ খাদ্য-সেক্টরে অস্থিতিশীলতার মূল কারণ।
তাই, এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ উর্বর কৃষিজমিকে পরিকল্পিত চাষাবাদের আওতায় আনার কোনও বিকল্প নেই। পাশাপাশি, উদ্ভূত সংকট মোকাবিলায় দ্রুত আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যা ইতোমধ্যেই সরকার শুরু করেছে।
মূলত, ভারতের গমের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে চবলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।