রেকর্ড দাম বৃদ্ধির ১০ দিন পরও বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের বাজার স্বাভাবিক হয়নি। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই এখনো সয়াবিন তেলের সংকট রয়েছে। সুপারশপ, কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লা, অলিগলির মনোহারি দোকানে অনেক জায়গায় কাঙ্খিত তেল পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও ২ লিটার ৫ লিটারের বোতল পাওয়া যাচ্ছে তো ১ লিটার মিলছে না। আবার কোথাও ১ লিটার মিলছে তো ২ লিটারের বোতল লাপাত্তা। অনেক জায়গায় সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি নেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোথাও আগের কেনা তেল বিক্রি হচ্ছে বর্ধিত দামে।
এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযানে বেরিয়ে আসছে লাখ লাখ লিটার মজুদ সয়াবিন। সব মিলিয়ে এক অরাজক পরিস্থিতি!
গত ৫ মে সরকার ভোজ্যতেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়িয়ে বোতলজাত প্রতি লিটার ১৯৮ এবং খোলা প্রতি লিটার ১৮০ টাকা ধার্য করে। ৫ লিটারের বোতল ৯৮৫ টাকা এবং পামঅয়েল প্রতিলিটার ১৭২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দাম বাড়ানোর পরও বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ ছিল না। ব্যবসায়ীর আমদানি কম হওয়ার কথা বলেন। কিন্তু গণমাধ্যমে খবর আসে অধিক মুনাফার লোভে অসাধু ব্যবসায়ীরা তেল মজুদ করে রেখেছেন।
৬ মে ভোজ্যতেলের বর্ধিত দাম কার্যকর হওয়ার এক সপ্তাহ পর ১২ মে চীন আন্তর্জাতিক বেতারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, কাঁচাবাজারগুলোতে তেল মিললেও পাড়া-মহল্লা আর অলিগলির অনেক দোকানেু মিলছে না সয়াবিন। প্রথম কয়েকদিন রাজধানীর অনেক সুপারশপেও সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি।
আর তেল মিললেও বেশি দামের পাশাপাশি আরেক উপদ্রব যোগ হয়েছে। সয়াবিনের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে সর্ষে তেল, চাপাতা, চিনি, লবন, প্যাকেটজাত হালিম-ফিরনির মতো পণ্য কিনতে হচ্ছে। এ যেন আক্ষরিক অর্থেই মগের মুল্লুক। ভোক্তাদের প্রয়োজন নেই অথচ সয়াবিনের জন্য তাদের অপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হচ্ছে।
এমন একটা পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বেরিয়ে আসছে মজুদ করা লাখ লাখ লিটার সয়াবিন তেল। ১১ মে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পাতার শিরোনাম ৭ জেলায় প্রায় ২ লাখ লিটার তেল জব্দ। ১২ মে একই পত্রিকায় শিরোনাম আরও এক লাখ লিটার তেল জব্দ। ১৫ মে শিরোনাম ১৩ জেলায় অভিযান: ১ লাখ ২১ হাজার লিটার ভোজ্যতেল জব্দ। দেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমে আসছে মজুদ তেল জব্দ করার খবর। তবে এটি প্রকৃত অবস্থার কিছু খণ্ডচিত্র মাত্র। বোদ্ধামহল মনে করে, অভিযান চালানো হলে দেশের সর্বত্রই মিলবে মজুদ তেল।
গণমাধ্যমের খবরে দেখা যাচ্ছে, মজুদকারীদের নামমাত্র জরিমানা করে জব্দ করা তেল খোলা বাজারে বিক্রির নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যারা অধিক মুনাফার লোভে তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জনভোগান্তি ঘটিয়েছে, তাদের জন্য নামমাত্র জরিমানা যথাযথ শাস্তি কিনা- এ প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে। কঠোর শাস্তির বিধান থাকলে এমন অনৈতিক মজুদদারি কিছুটা হলেও কমতে পারে।
এরই মধ্যে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’- শুধু ভোজ্যতেল নয়, ঈদের পর বাজারে আরেক দফা বেড়েছে অনেক নিত্যপণ্যের দাম। সয়াবিনের দাম বাড়ার সুযোগে অনেকটা নীরবেই বেড়েছে সর্ষে তেলের দাম। সয়াবিন না পাওয়াতে অনেকে ভোজ্যতেল হিসেবে সর্ষে তেল ব্যবহার করছিলেন। সঙ্গত কারণেই চাহিদা বেড়েছে। আর যায় কোথা- দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বিক্রেতারা। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, ঈদের পর গত এক সপ্তাহে পেঁয়াজ, মসুর ডাল, চিনি, আটা, ময়দা, ডিম, গুড়ো দুধের দাম বেড়েছে।
কেন দাম বাড়লো? জবাব প্রস্তুত। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমায় আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
ভালো কথা-ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমায় আমদানি করা বিদেশি পেঁয়াজ আর মসুর ডালের দাম বেড়েছে। কিন্তু দেশি পেঁয়াজ আর মসুরের ডালের দাম কেন বাড়লো?
জবাব- দেশি পেঁয়াজ আর মসুর ডালের সরবারহ কম। পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে দেশি মসুর ডালের সরবরাহ কম কথাটা ঠিক নয়- বলছেন কোনো কোনো ব্যবসায়ী। আসলে বিদেশি মসুর ডালের দাম বেড়েছে ব্যস- এই সুযোগেও দেশিটারও দাম বাড়িয়ে দাও- এ হলো মোদ্দা কথা।
বাজারের এহেন অস্থিতিশীল, অনিয়ন্ত্রিত, অরাজক অবস্থায় শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্তের জীবন আর বাঁচে না। ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করেছিলাম- তারা বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন- এমন সাফাইয়ের বদলে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াটাকে কীভাবে বাগে আনা যায়-বাগে রাখা যায় সে পথ খোঁজাটাই উচিত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।