রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ শুরুর পর থেকে ৬০ লাখের বেশি মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়েছে। এসব মানুষের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বাড়িঘর হারিয়ে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত হয়েছে আরও কয়েক লাখ শিশু। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা এ তথ্য জানিয়েছে। পাশাপাশি ৪০০ বাংলাদেশি নিরাপদে ইউক্রেন সীমান্ত অতিক্রম করে পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও রোমানিয়ার নিরাপদ স্থানে পৌঁছেছে বলে জানা গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি ও শরণার্থী সংকট নিয়ে বিস্তারিত থাকছে আজকের সংবাদ পর্যালোচনায়।
গোটা বিশ্বে শরণার্থী সংকট নতুন কিছু নয়। কেউ জীবন বাঁচাতে, কেউবা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায়। প্রাচীনকাল থেকেই মানবজাতির এই মাইগ্রেশন বা স্থানান্তর ঘটে আসছে। এ যেন প্রবহমান জীবনেরই একটি অংশ। জীবনের স্বাভাবিক প্রয়োজনে মানুষ যখন স্থানান্তরিত হয়, তখন তাতে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয় না। কিন্তু, যুদ্ধ-সংঘর্ষ, নানা রকম দুর্যোগের কারণে মানুষ যখন বাধ্য হয় ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে, তখনই মূলত সংকটাবস্থা দেখা দেয় এবং অস্বাভাবিক ও কষ্টকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রুশ-ইউক্রেন সংঘাত শুরু গলে ১১ মে পর্যন্ত ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়েছে অন্তত ৬০ লাখ ২৯ হাজার ৭০৫ জন মানুষ। সংস্থাটি জানায়, ইউক্রেন ছেড়ে যাওয়া এসব মানুষ সবচেয়ে বেশি আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ডে। ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী ইউক্রেনীয় পুরুষ সামরিক চাকরির জন্য দেশ ত্যাগ করতে পারেনি। তাই শরণার্থীদের ৯০ শতাংশই ছিল নারী ও শিশু। তবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনের সীমান্ত জুড়ে প্রতিদিন শরণার্থীদের দেশ ত্যাগের প্রবণতা কিছুটা কমেছে। জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত মার্চ মাসে দেশ ছেড়েছিল ৩৪ লাখ ইউক্রেনীয় নাগরিক। এপ্রিল মাসে দেশ ছাড়ে ১৫ লাখ মানুষ। মে মাসের শুরু থেকে, প্রায় ৪ লাখ ৯৩ হাজার ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় চেয়েছে। জাতিসংঘ ধারণা করছে- এ বছর সর্বমোট ৮০ লাখের বেশি মানুষ ইউক্রেন থেকে চলে যেতে পারে।
জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার- আইওএম এক গবেষণার পর জানায়, দেশটিতে অভ্যন্তরীণভাবেও স্থানান্তরের ঘটনা ঘটেছে। দেশের ভেতর ৮০ লাখ মানুষ যুদ্ধ-সংঘাতের স্থান ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। ইউক্রেনের অর্থমন্ত্রী সের্হি মার্চেনকো বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে বলেন, তার দেশ রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে ৮৩০ কোটি ডলার ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত লোকদের জন্য অস্ত্র কেনা ও মেরামত করা থেকে জরুরি সহায়তা কাজে এ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৪০০ বাংলাদেশি ইউক্রেন ছেড়েছে। তারা সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও রোমানিয়াতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তাদের মধ্যে ৪৬জন বাংলাদেশি ওয়ারশতে বাংলাদেশ দূতাবাসের ব্যবস্থা করা অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছেন। বাকিদের দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও তারা নিজস্ব ব্যবস্থায় অবস্থান করছেন। ১৫জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী হাঙ্গেরিতে পৌঁছেছেন।
দূতাবাস আইসিআরসি, ইউক্রেনের মাধ্যমে ২৮ বাংলাদেশি নাগরিককে এখন পর্যন্ত উদ্ধার ও স্থানান্তর করা হয়েছে। দূতাবাস আইওএম, ইউক্রেনের মাধ্যমে ইউক্রেনে আটক বাংলাদেশিদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ করা হয়েছে।
পাশাপাশি, জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়ে, সর্বাত্মক হামলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া এসব শরণার্থীর মধ্যে শিশুর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তাদের সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি।
বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, আগামী দিনগুলোতে মানবসৃষ্ট নানা দুর্যোগের কারণে বাস্তুহারা ও শরণার্থীর সংখ্যা বাড়বে। পাশাপাশি রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধির মতো ঝুঁকিতে বিশ্বজুড়ে মানুষের স্থানান্তরের পরিমাণ হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে। এরমধ্যে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা ও যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে মানবজাতি নিজেদেরকেই মহা বিপর্যয়ে নিক্ষেপ করবে। তাই সচেতনভাবে প্রতিটি দেশ ও প্রশাসনকে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে ফিরে আসা জরুরি।
মোহাম্মদ তৌহিদ; বার্তা সম্পাদক, সিএমজি বাংলা বিভাগ।