বাংলাদেশে সয়াবিন তেল নিয়ে তেলেসমাতি: জনভোগান্তির দায় কার?
2022-05-08 19:28:56

সয়াবিন তেল নিয়ে দেশে গত কিছু দিন ধরে যে কাণ্ড ঘটছে তাকে তেল নিয়ে তেলেসমাতিই বলতে হবে! বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে গত ৫ মে সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসে এক দফায় সর্বোচ্চ দাম বাড়ায়। বোতলজাত প্রতি লিটার তেলের দাম ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা করা হয়।  খোলা তেলের দাম লিটার প্রতি ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরদিন ৬ মে থেকেই নতুন দাম কার্যকর হয়।

একবারে এত বেশি দাম বাড়ানো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে সঙ্গতকারণেই। কিন্তু এতটা দাম বাড়ানো হলেও সয়াবিন তেলের সংকট কাটেনি। রাজধানী ঢাকার প্রধান প্রধান কাঁচাবাজারগুলোতে বর্ধিত দামেও তেল মিলছে না। বেশিরভাগ খুচরা বিক্রেতা বলছেন তাদের কাছে তেলের সরবরাহ নেই। কোনো কোনো দোকানে মিললেও তা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি- বোতলজাত প্রতি লিটার ২১০ টাকা এবং খোলা তেল বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। বাজারে তেলের এহেন তেলেসমাতিতে নাজেহাল ভোক্তাসাধারণ!

বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে ক্রেতাদের ভোগান্তি নৈমিত্তিক একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তেল নিয়ে যা চলছে তা সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু কেন এমন একটা সংকট তৈরি হলো যে- রেকর্ড দাম বাড়িয়েও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নিত্য এ পণ্যটি মিলছে না?

দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়া ও সংকট নিয়ে অভিযোগের একটি দুষ্টচক্র রয়েছে। বাজারে তেল নেই- খুচরা বিক্রেতারা বলছে পাইকার প্রয়োজন মতো সরবারহ করছে না। পাইকার বলছে মিল মালিকরা পর্যাপ্ত তেল দিচ্ছে না। মিল মালিক ও আর আমদানিকারকা বলছে অমুক কারণে পর্যাপ্ত আমদানি করা যাচ্ছে না; আমদানি ব্যয় বাড়ছে সরকার শুল্ক কমাচ্ছে না ইত্যাদি। আর সরকার বলছে তারা সব কিছু করেছেন- কিন্তু অতি মুনাফার লোভে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। বিরোধী দল বলছে- সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। বাজার সিন্ডিকেটকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এত এত অভিযোগের পাহাড়। কিন্তু এতে ভোক্তাসাধারণে ভোগান্তির অবসান হয় না।

এখানে প্রথম প্রশ্ন সয়াবিনের দাম এতটা বাড়লো কেন?

দেশে বছরে ২০ লাখ টন সয়াবিন তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। আর এর সবটুকুই নিয়ন্ত্রণে করে দেশের ৭-৮টি প্রধান শিল্পগ্রুপ। তারা বলছে, বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য বাড়ার কারণে দেশেও দাম বাড়াতে হয়েছে।

এটা ঠিক যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার কারণে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ওঠা-নামা করছে- অর্থাৎ বাড়ছে-কমছে। কিন্তু সেটা কতটা? গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যউপাত্তে দেখা যায়, গত এক বছরে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৩ শতাংশের মতো। আর দেশের বাজারে তা বেড়েছে ২৭ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো দেশের বাজারে ৬ মে যখন তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়লো, সে দিনই বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম কমেছে ১ দশমিক ১৩ শতাংশ।

অর্থাৎ বিশ্ববাজারের দোহাই পাড়া হলেও এর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না আমদানিকারক ও সরকার কোনো পক্ষই। আর বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশে অবধারিতভাবে দাম বাড়ে। কিন্তু যখন বিশ্ববাজারে দাম কমে তখন সে বিষয়ে সবসময় খেয়াল দিতে দেখা যায় না সংশ্লিষ্টদের।

দ্বিতীয় যে গুরুতর প্রশ্নটি তা হলো- মানা  গেলো বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় রেকর্ড দাম বেড়েছে দেশের বাজারে। কিন্তু বর্ধিত দামেও বাজারে তেল পাওয়া যাচ্ছে না কেন?

আমদানিকারকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে, কোনো কোনো দেশ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে, কোনো কোনো দেশে উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে, সরকার শুল্ক কমাচ্ছে না- এ সব কারণে আমদানি কম হয়েছে তাই সরবরাহে ঘাটতি।

এটা ঠিক যে গত দু’মাসে দেশে ৯২ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে- যা গত ৭ বছরে সর্বনিম্ন। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সয়াবিন রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে, আর্জেন্টিনা কমিয়ে দিয়েছে আর ব্রাজিল ও কানাডায় খরায় উৎপাদন কমেছে। কিন্তু এর মধ্যেই যে তেল আমদানি হয়েছে এবং আগে যা মজুদ ছিল সে তেল কোথায় গেলো? বাজার থেকে রাতারাতি হাওয়া হয়ে গেল সব তেল?

বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার গত দুমাসে চার বার তেলের মূল্য সমন্বয় করেছে। একাধিকবার শুল্ক কমিয়েছে। সবশেষে রেকর্ড দাম বাড়িয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, মার্চে ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী দাম না বাড়ানোয় মিল মালিকরা কৌশলে সরবরাহ কমিয়ে দেয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এর ব্যাখ্যা তলব করে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।

দৃশ্যত ঈদের পরে সয়াবিনের দাম বাড়বে এ খবর প্রকাশের পরই অতিরিক্ত মুনাফার লোভে পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ী যে যার মতো তেল মুজদ করেছেন- এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আর ভবিষ্যতে দাম আরও বাড়তে পারে এমন ধারণা থেকে বর্ধিত দামেও তারা তেল বিক্রি করছেন না।

সরকারের আশু করণীয় এখন বাজারে তেলের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং ভোক্তাদের অশেষ ভোগান্তির হাত থেকে মুক্তি দেওয়া।

মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।