সি চিন পিং এবং তাঁর মা-এর গল্প
2022-05-06 10:28:21

অনেকেই বলে, মা হলেন শিশুর জীবনের প্রথম শিক্ষক। মা শুধু শিশুকে বড় হওয়ার ক্ষেত্রেই যত্ন নেন- এমন নয়, বরং শিশুকে শিক্ষা দেন, সত্য-মিথ্যা
‌জানান। তাহলে একটি দেশের শীর্ষনেতার মা কেমন নারী4, শীর্ষনেতা হিসেবে তিনি ও তাঁর মা-এর দৈনন্দিন জীবন কেমন ছিল? আজকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং তাঁর মা-এর গল্প আপনাদের বলবো।

 

২০১৫ সালে চীনের ঐতিহ্যবাহী বসন্ত উত্সব উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভায় সি চিন পিং চীনের থাং রাজবংশের বিখ্যাত কবি মেং চিয়াও-এর বিখ্যাত কবিতা ‘বাড়ি থেকে দূরে একটি জায়গায় ভ্রমণ বা বসবাসকারী মানুষের অনুভূতি’ আবৃত্তি করেন। এতে বলা হয়, মা-এর হাতের সুই, বাসা থেকে অনেক দূরে থাকা ছেলের গায়ের কাপড়। চলে যাওয়ার আগে মা ভালোভাবে ছেলের জন্য পোশাক তৈরি করেন, ছেলে দেরিতে ফিরে আসার উদ্বিগ্ন হন। কে বলে, ছোট ঘাসের ছোট হৃদয়, সূর্যের উষ্ণতায় প্রতিদান দিতে পারে না!

 

আসলে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর মা ছি সিন, সবসময় নিজেকে ছেলেমেয়ের জন্য দৃষ্টান্ত; শ্রেষ্ঠ গুণাবলী ছেলেমেয়েদের শেখান। সি চিন পিং মা ছি সিনের শিক্ষায় গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তিনি সবসময় মা-এর কথা মনে রাখেন।

প্রাচীনকালে চীনারা বলতেন, শিশুকে ভালোবাসলে ভালোভাবে তাকে শেখাতে হয়। সি চিন পিং-এর মতে, পরিবার হল মানুষের জীবনের প্রথম ক্লাসরুম। বাবা মা হলেন শিশুর প্রথম শিক্ষক।

চীনে অনেকেই জানেন সি চিন পিং-এর বাবা সি চুং সুন প্রাবীণ বিপ্লবী। তবে হয়তো অনেকেই জানে না যে, সি চিন পিং-এর মা ছি সিন যুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিলেন।

জাপান-বিরোধী যুদ্ধের সময় ছি সিন চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন, তখন থেকে তিনি সবসময় সিপিসি’র সদস্য হিসেবে কাজ করেন। সি’এর বাবা বলেছিলেন, সি-এর মা শ্রেষ্ঠ একজন সিপিসি সদস্য।

মা ছি সিন সি-এর জন্য খুব ভালো একটি দৃষ্টান্ত রেখেছেন। সি চিন পিং-এর এখনও মনে আছেন তাঁর মা তাঁকে নিয়ে বই দোকানে বই কেনার সেই মুহূর্ত। ছোটবেলায় মা সিকে নিয়ে বই দোকানে যেতে চান, তখন সি অলসতার কারণে হাঁটতে চাইতেন না। তাই মা সিকে পিঠে নিয়ে বই দোকানে যান এবং চীনের প্রাচীনকালের সুং রাজবংশের মহান বীর ইউয়ে ফেই-এর কাহিনীর এক কার্টুন বই সি’র জন্য কিনেন। ইউয়ে ফেই সুং রাজবংশের সময় দেশ রক্ষায় প্রাণের ঝুঁকিতে যুদ্ধে শত্রুদের পরাজিত করেন এবং দেশকে রক্ষা করেন। ইউয়ে ফেই যুদ্ধ মাঠে যাওয়ার আগে তাঁর মা সুই দিয়ে তাঁর পিঠে চারটি চীনা অক্ষর লেখেন, এর অর্থ: দেশকে রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করা’। মা সি চিন পিংকে এই গল্প জানিয়েছেন। তখন ছোট সি চিন পিং মাকে জিজ্ঞেস করেন, সুই দিয়ে অক্ষর লিখতেন, কত ব্যথা, কত না-বলা কথা। তবে তাঁর মা বলেন, হ্যাঁ, সত্যি ব্যথা, তবে এই ব্যথার কথাগুলো মনে থাকবে। তাই তখন থেকে সি চিন পিংও এই কথাকে নিজের মনে রেখেছেন, এটা হল সি চিন পিং-এর সারা জীবনের লক্ষ্য।

 

সি চিন পিং চাকরি করার পরই মা ছি সিন সবসময় সি চিন পিংকে শিখিয়েছেন এবং জনগণের কথা মনে রেখেছেন। ২০০০ সালের জুন মাসে, ছি সিন চাও জিন শহরে যান, যখন তিনি দেখেন যে স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের অবস্থা খুব খারাপ, ক্লাসরুম খুব জরাজীর্ণ। ভালো কোনো ডেস্ক ও চেয়ারও ছিল না। তখন ছি সিন পুরো পরিবারের সঞ্চিত ১.৫ লাখ ইউয়ান দিয়ে সেই প্রাথমিক স্কুল পুনরায় নির্মাণ করে দেন।

২০১৮ সালের মে মাসে সেই প্রাথমিক স্কুলের শিশুরা সি চিন পিংকে চিঠি লেখে। চিঠিতে তারা সিকে চীনের ইতিহাস শেখা এবং স্কুলের উন্নয়নের কথা জানায়। এক সপ্তাহ পর সি চিন পিং তাদের জবাবি চিঠি দেন। এসব শিশুকে ভালোভাবে লেখাপড়া করার উৎসাহ দেন তিনি।

সি চিন পিং-এর মা ছি সিন মনে দৃঢ় সংকল্প থাকা এমন একজন নারী। সবচেয়ে কঠোর সময়েও তিনি কখনই জীবন সম্বন্ধে হতাশা হন নি, বরং দৃঢ় সংকল্প এবং আস্থাবান মনোভাব দিয়ে শিশুদের শিখিয়েছেন।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে, যখন সি চিন পিং-এর বয়স ১৬ বছরের মতো; তখন তিনি গ্রামে কৃষক হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছিলেন। সেই জায়গার নাম হল লিয়াং চিয়া হ্য। চীনে একটি কথা আছে: ছেলে হাজার মাইল দূরে গেলে মা-এর উদ্বিগ্ন হয়। তখন ছি সিন সি’র জন্য নিজ হাতে একটি ব্যাগ তৈরি করেন, এতে সুই ও সুতা দিয়ে তিনটি লাল রং-এর চীনা অক্ষর সেলাই করা আছে। তা হলো:- মা-এর হৃদয়।

সাত বছর ধরে গ্রামে কাজ করেছেন সি, আর এই ব্যাগ সবসময় কাছে ছিল। সি চিন পিং কখনই মাকে হতাশ করেন নি। কঠোর জীবনে সি-এর মানসিক অবস্থা আরো দৃঢ় হতে থাকে এবং তিনি স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক স্থাপন করেন। তখন তিনি জনসাধারণকে ভালো কাজ করার লক্ষ্যও নির্ধারণ করে দেন।

 

লিয়াং চিয়া হ্য ত্যাগ করার সময় সি চিন পিং মা-এর তৈরি এই ব্যাগ তাঁর প্রতিবেশী চাং ওয়েই ভাংকে  দেন। তিনি বলেন- আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি, তবে আমার হৃদয় এখানে রাখা আছে। আর লিয়াং চিয়া হ্য এই জায়গাও যেন সি চিন পিং-এর ‘জীবনের প্রথম ধাপ’ রাখার জায়গা।

 

সি চিন পিং-এর বড় হওয়ার প্রক্রিয়ায় মা ছি সিন সবসময় তাঁকে ভালোভাবে আচরণ করার পরামর্শ দেন। যখন সি চিন পিং নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন ছি সিন পরিবারের রীতিনীতি অনুযায়ী তাঁকে চিঠি লিখে জানান: পদ বড় হলে দায়িত্বও বড় হয়। আরো কঠোর মানসিক শক্তি দিয়ে কাজ করতে হয়। ছি সিন বিশেষ একটি পারিবারিক সম্মেলন আয়োজন করেন, সব ছেলেমেয়েদের নির্দেশ দেন যে, কেউ সি চিন পিং-এর ক্ষমতার অধীনে ব্যবসা করতে পারবে না।

 

বাবা মা’র প্রভাব ও কঠোর দাবি অনুযায়ী সি চিন পিংও উঁচু মানদণ্ড অনুযায়ী কাজ করেন। যখন তিনি নেতা হন, তখন যেখানে তিনি যান, সেখানে তিনি আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুদের বলেন, আমার কাজ করার জায়গায় ব্যবাসায়িক কাজ করা যাবে না, আমার নামে কোনো কাজ করা যাবে না, তাহলে আমাদের সম্পর্ক চ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ফুচিয়ান প্রদেশ হোক, চ্য চিয়াং প্রদেশ হোক, শাংহাই শহর হোক, যেখানে তিনি কাজ করেছিলেন, সেখানে তিনি কর্মকর্তাদের সম্মেলনে এসব কথা বলেছিলেন। কেউ তাঁর নামে ব্যক্তিগত স্বার্থ অর্জন করতে পারবে না।

 

সি চিন পিংয়ের কার্যালয়ে সবসময় একটি ছবি রাখা আছে। ছবিতে তিনি ও তাঁর মা হাত ধরে হাঁটছেন। এই মুহূর্ত দেখতে অনেক উষ্ণ।

সি চিন পিং মাকে খুব উঁচু মানের সম্মান করেন। সময় পেলে নিশ্চয়ই মা-এর সঙ্গে খাবার খান এবং খাওয়া শেষে মা-এর হাত ধরে হাঁটেন, আড্ডা দেন। একটু সময় পেলে তিনি অবশ্যই মা-এর সঙ্গে কিছু সময় কাটান।

তবে নেতা হওয়ার পর সি চিন পিং-এর কাজ অনেক বেড়ে যায়। ছুটির দিনেও বাসায় ফিরে  মাকে দেখতে পারেন না। ২০০১ সালের বসন্ত উত্সবের সময় সি চিন পিং বাসায় ফিরে বাবা মা’র সঙ্গে দেখা করতে পারেন নি। মা সি চিন পিং-এর সঙ্গে একবার ফোনে কথা বলেছেন, ফোনে মা সি চিন পিংকে বলেন, তুমি ভালোভাবে কাজ করলে আমি ও তোমার বাবা খুশি হবো।

 

ভালোভাবে কাজ করলে বাবা মা খুশি হবেন। বহু বছর ধরে সি চিন পিং মা-এর কথাগুলো মনে রেখেছেন। খুব পরিশ্রমী কাজ করেন। সি চিন পিং-এর সঙ্গে যারা কাজ করেছিলেন, তারা স্মরণ করে বলেন, সি চিন পিং-এর কাজের দক্ষতা খুবই ভালো, তবে কাজ এত বেশি করেন যে, সাপ্তাহিক ছুটিতেও বিশ্রাম নেন না, সবসময় ওভারটাইম কাজ করেন। সি চিন পিং নিজেও স্মরণ করে বলেন, বিভিন্ন স্থানে কাজ করার সময় ছুটির দিনে তিনি কখনই বিশ্রাম নেন নি, যাতে সবসময় দায়িত্ব পালন করা যায়।

 

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টাদশ কংগ্রেসের পর থেকে সি চিন পিং-এর কাজ আরও বেড়ে গেছে। ফাইল যত দেরিতে তাঁকে দেওয়া হোক না কেন, মধ্যরাত হলেও তাড়াতাড়ি তাঁর জবাব পাওয়া যায়। বিদেশ ভ্রমণে তাঁর কর্মসূচির প্রতিটি মিনিট হিসাব করতে হয়। চীনের বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শনের সময় তিনি পা দিয়ে মেপে মেপে দেশ পরিমাপ করেন, জনগণের মনের কথা শোনেন।

সি চিন পিং-এর নেতৃত্বে, চীনের অর্থনীতির পরিমাণ ১১০ ট্রিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়েছে, যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত করেছে। প্রায় ১০ কোটি গ্রামীণ মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে চীন চরম দারিদ্র্যের সমস্যা সমাধান করেছে। মা-এর শিক্ষা ইতোমধ্যে সি চিন পিং-এর দেশ পরিচালনার চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে।