বিশ্বের একটি কৌশলগত স্বায়ত্তশাসিত ইউরোপ প্রয়োজন: সিএমজি সম্পাদকীয়
2022-04-26 15:23:46

এপ্রিল ২৬: স্থানীয় সময় গতকাল (সোমবার) ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এমানুয়েল ম্যাকখোঁ পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ’র কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র হিসেবে ফ্রান্স বরাবরই ইউরোপের একীকরণ এগিয়ে নেওয়া এবং কৌশলগত স্বাধীনতার মেরুদণ্ড হিসেবে ভূমিকা রাখে। ইউরোপীয় মহাদেশে নতুন করে যুদ্ধের পটভূমিতে ম্যাকখোঁর পুনঃনির্বাচন বিশেষভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইউরোপীয় পরিষদের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল বলেন, এই অস্থির সময় আমাদের একটি স্থিতিশীল ইউরোপ এবং এমন একটি ফ্রান্স দরকার, যা ইইউ-কে আরও স্বাধীন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

 

স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতা ফ্রান্সের পররাষ্ট্রনীতির ঐতিহ্য। ম্যাকখোঁর প্রথম মেয়াদে ফ্রান্স ও ইউরোপের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বাড়ানোর প্রচেষ্টা করা হয়েছিলো। ‘কিছু মিত্রের উপর নির্ভরতা কমানো’ ছিল তার উদ্দেশ্য। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্স অস্ট্রেলিয়ার ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সাবমেরিনের অর্ডার হারানোর পর ম্যাকখোঁ প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই নিজের কৌশলগত স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রাখে।

 

পুনর্নির্বাচন কার্যক্রমে ম্যাকখোঁ প্রথম কার্যমেয়াদের অভিজ্ঞতা অনুসারে আরো স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ফ্রান্স গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করেন। এতে মানুষ সমর্থন জানিয়েছে। এটি তার পুনর্নির্বাচনের পর প্রথম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার দেশের মতভেদ কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ প্রতিফলিত হয়েছে।

 

রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘর্ষ হলো ইউরোপের সম্মুখীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা ফ্রান্সের স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ম্যাকখোঁ বারবার জোর দিয়ে বলেছেন, পরিস্থিতির অবনতি এড়ানো উচিত্। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের উস্কানিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপের নিষেধাজ্ঞা অব্যাহতভাবে বাড়ছে এবং এর প্রতিক্রিয়াও সুস্পষ্ট হচ্ছে। ইইউ’র পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ইউরো অঞ্চলে মুদ্রাস্ফীতির হার মার্চ মাসে ইতিহাসের রেকর্ড ভেঙে ৭.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে এবং কিছু দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ১৫.৬ শতাংশে পৌঁছেছে। জ্বালানির দাম ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধির পর ইউরোপীয়রা অভিযোগ শুরু করেছে।

 

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মার্কিন উস্কানিতে ইউরোপ ইতোমধ্যেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘর্ষের বিরাট শিকারে পরিণত হয়েছে। ইউক্রেন সংকট সৃষ্টিকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাশিয়াকে দমন করছে এবং নিজের ওপর ইউরোপকে নির্ভরশীল করে ফেলছে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য হিল’ পত্রিকায় বলা হয়, মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েল্লেন এ সত্য স্বীকার করে বলেছেন যে, রাশিয়ার জ্বালানির খাতে ইইউ’র সার্বিক নিষেধাজ্ঞা রুশ অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, তবে এই পদক্ষেপের পরিণতি ইউরোপকেই বহন করতে হবে।

মার্কিন আচরণে ইউরোপ স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের স্বার্থ যখন সংঘাতে পড়বে, যুক্তরাষ্ট্র তখন তার মিত্রদের ত্যাগ করতে দ্বিধা করবে না। এই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের উপর তার কৌশলগত নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য ইউরোপের আহ্বান আরও জোরালো হয়েছে। ইইউ গত মাসে একটি ‘কৌশলগত পরিকল্পনা’ ঘোষণা করেছে এবং ন্যাটো থেকে পৃথক ও স্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক শক্তি ও ইউরোপের নিজস্ব নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে।

 

এক্ষেত্রে ইউরোপ আরও কিছু করতে পারে। যেমন ধরুন, চীনের সঙ্গে সম্পর্কে ইউরোপেরও উচিত একটি পরিষ্কার সম্পর্ক বিবেচনা করা এবং চীন সম্পর্কে যৌক্তিক বোঝাপড়া বাড়ানো। সম্প্রতি, মার্কিন স্থায়ী উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী শেরম্যান ইইউ সফর করেছেন এবং তথাকথিত তৃতীয় ‘যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ-চীন ডায়ালগ’-এর কথা উল্লেখ করে চীনের বিরুদ্ধে অপবাদ দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য হলো ইউরোপ, রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালানো। ফলে নিজের নিরঙ্কুশ নিরাপত্তা ও আধিপত্য বজায় রাখা যাবে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ধাপে ধাপে স্থাপন করা ‘আমেরিকান ফাঁদ’ এবং ইউরোপের এটি উপেক্ষা করা উচিত্ নয়।

 

ইউরোপের কৌশলগত স্বাতন্ত্র্য পথে যাত্রা সুষ্ঠু হবে না। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে রাখলে তা নিজের জন্য ক্ষতিকর হবে। ইউরোপের ভাগ্য ইউরোপীয়দের হাতেই থাকা উচিত্। ‘ইউরোপীয় কৌশলগত স্বতন্ত্র’ বিষয়ে ম্যাকখোঁ’র ঘোষণা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাস্তবায়ন করা উচিত্। বিশ্বের একটি কৌশলগত স্বায়ত্তশাসিত ইউরোপ প্রয়োজন এবং ইউরোপ একটি অশান্ত ও পরিবর্তনশীল বিশ্বে আরও স্থিতিশীল ও  নিশ্চয়তা যুক্ত করতে পারবে।  লিলি/তৌহিদ/শুয়ে