চাকরি নেওয়ার আগে কম্পানি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে
2022-04-25 16:02:53

শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নেওয়া একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কোন চাকরিতে ঢুকতে হবে, চাকরিতে ঢোকার পর কীভাবে সেখানে উন্নতি করতে হবে, ইত্যাকার নানান প্রশ্নের সঠিক উত্তর তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

চীনে মে মাস হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের জন্য চাকরি অফার পাওয়ার মৌসুম। আজকাল শুধু চীনের কম্পানিগুলো শিক্ষার্থীদের চাকরির সাক্ষাত্কার নেয়, তা নয়; শিক্ষার্থীরাও চাকরির আবদেন করার আগে বিভিন্ন কম্পানি যাচাই-বাছাই করে থাকে। সেরা শিক্ষার্থীরা সাধারণত একাধিক অফার পেয়ে থাকেন। তখন তাদেরকে দেখতে হয়, কোন কম্পানিতে চাকরি করা তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে।

চীনের চ্যচিয়াং প্রদেশের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী চৌ স্যু কয়েকটি কম্পানির কাছ থেকে ইন্টারভিউপত্র পান। তিনি জানান, চাকরির জন্য আবেদন করার আগেই তিনি বিভিন্ন কম্পানি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। গত বছরের জুন মাস থেকে তিনি এ কাজ শুরু করেন। সংশ্লিষ্ট কম্পানির কর্মসংস্থানের অবস্থা, মাসিক বেতন, সেখানে উন্নতির সম্ভাবনা, কোম্পানির রাঙ্কিং আর ভোগৌলিক অবস্থানসহ নানান তথ্য তিনি সংগ্রহ করেন।

সংশ্লিষ্ট তথ্য যাচাই করার পর ৬টি কম্পানিকে তিনি তার প্রিয় তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। এবং সবশেষে তিনি সবচেয়ে ভালো কম্পানিটি বেছে নেন।

আসলে চৌ’র মতো শিক্ষার্থী আরও অনেক আছে। তারা নতুন চিন্তাভাবনা ও ধারণা নিয়ে চাকরি খুঁজতে চায়। কেবল সুবিখ্যাত ৫০০টি শক্তিশালী কোম্পানি বা ৪এ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর মনোযোগ দেয় না তারা, বরং নিজের জন্য উপযোগী কম্পানিই খুঁজে বের করার চেষ্টা করে।

চাকরি নেওয়ার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা কম্পানি আবেদনকারী শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট তথ্য বা পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়। এটা একটি প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া। আবেদনকারী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, আগে কোনো কম্পানিতে কাজ করেছে কি না, কাজের অভিজ্ঞতা আছে কি না—ইত্যাদি নানান তথ্য কম্পানিগুলো সংগ্রহ করে।

মেয়ে ছেন রান স্বাধীন ও নমনীয় কর্মপরিবেশ পছন্দ করেন। তাই চাকরির আবেদনের সময়, একজন আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতক হিসেবে, তিনি অনলাইন ব্যবসা কোম্পানি ও সুবিখ্যাত অ্যাকাউন্টিং ফার্মের ওপর নজর রাখেন। কেবল ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কম্পানি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা নয়, বরং সরকারি ওয়েবসাইট ও বিভিন্ন ধরনের এপিপি থেকে বিভিন্ন কম্পানি সম্পর্কে তিনি জানার চেষ্টা করেন। অবশেষে তিনি একটা ভালো কম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

কম্পানি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে গিয়ে ছেন রানের মনে পেশায় উন্নত হবার প্রতি গভীর আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় ইন্টারনেটের সুবিখ্যাত কোম্পানিতে আকর্ষণীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্পর্কে তিনি জানতেন। তিনি এমন বিষয় বেছে নেন, যে বিষয়ে চাকরি পাবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। শেষয় পর্যন্ত তিনি তার জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান বেছে নিয়েছেন।

অনলাইনে বিভিন্ন কম্পানির কর্মপরিবেশসম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের কয়েকটি পর্যায় রয়েছে। সাধারণত বিভিন্ন এপিপি বা ইন্টানেট ওয়েবসাইট থেকে কম্পানির কর্মসংস্থানের তথ্য খোঁজা যায়। কেউ কেউ নিজের পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের কাছ থেকে কম্পানির বেতন ও ছুটির ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে খোঁজ পান। তা ছাড়া, কম্পানির সার্চিং ওয়েবসাইট থেকে কম্পানির বেতনের স্কেল আর মালিক ও পুঁজি বিনিয়োগকারীদের তথ্যও পাওয়া যায়।

পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী লিলি দ্বিতীয় বর্ষ থেকে বিভিন্ন ইন্টার্নশিপ করে আসছেন। কাজ করার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন কম্পানির তথ্য সংগ্রহে অভ্যস্ত হন। তাঁর অভিজ্ঞতায় ইন্টারনেট, ম্যাগাজিন, বই বা ফাইল থেকে সংগ্রহ তথ্য বিচার করা অতি গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া নিজেদের পরিচিত বন্ধু বা সহপাঠীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন কম্পানিসংশ্লিষ্ট তথ্য আরও গুরুত্বপূর্ণ।

কম্পানি সম্পর্কে কি শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি সংখ্যায় খোঁজ-খবর নিয়ে থাকে? এ সম্পর্কে হুনান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইয়ু হান ইয়ু বলেন, “আসলে স্নাতক শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ প্রবণতা ব্যাপক। আমরাও কর্মসংস্থানসংশ্লিষ্ট এমন খোঁজ-খবর নিতে শিক্ষার্থীদের উত্সাহ দিয়ে থাকি। শিক্ষার্থীরা কম্পানিতে কর্মরত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র স্নাতক শিক্ষার্থী বা সহপাঠীদের কাছ থেকে কম্পানির কর্মপরিবেশ সম্পর্কে জানা সহজ। তবে, অনেক বিস্তারিত তথ্য কেবল কম্পানিতে যোগ দেওয়ার পরই জানা সম্ভব।”

নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা জন্ম থেকেই বলতে গেলে ইন্টারনেটের সাথে পরিচিত। তারা অনলাইনে সহজে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। তাই, আজকালকার শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কম্পানি সম্পর্কে, কম্পানির কর্মপরিবেশ সম্পর্কে সহজেই খোঁজ-খবর নিতে পারে ও নিয়ে থাকেও।

কম্পানি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে কী সুবিধা পাওয়া গেছে বা যায়? এ প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষার্থীরা বলেন, খোঁজ-খবর নিয়ে তারা কম্পানি সম্পর্কে আরও বেশি প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়েছেন এবং ইন্টারভিউর সময় তাদের আত্মবিশ্বাস এতে বেড়েছে। অতীতে শিক্ষার্থীরা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা ও থিসিসসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতেন। আর কর্মসংস্থানের জন্য কম্পানির নিয়োগপরীক্ষার ওপর নির্ভর করতেন। তখন তাদের কাছে একটা চাকরিই ছিল যথেষ্ট। কর্মপরিবেশ, বেতন ইত্যাদি নিয়ে ভাবার কথা তাদের মাথায় আসতো না। কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়েরা নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের মূল্য দিতে শিখেছে; কোন কম্পানিতে কাজ করলে তাদের লাভ হবে, তা তারা হিসেব করতে শিখেছে। মেয়ে ছেন রান মনে করেন, চাকরির আবেদন করার আগে সংশ্লিষ্ট কম্পানি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া জরুরি।  এতে কম্পানির চাহিদা অনুসারে সংশ্লিষ্ট সাক্ষাত্কারের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যায়। এতে সাক্ষাত্কারে ভালো করার সম্ভাবনাও বাড়ে।

ছেলে হু পান বেইজিংয়ে চাকরি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার মেজর ছিল শহর ও জেলা পরিকল্পনা। এক বছর আগে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। তিনিও চাকরির আবেদন করার আগে কম্পানি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। তিনি বলেন, যুবকালটা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। এই মূল্যবান সময় একটি ভুল কম্পানি কাজ করে নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কর্মসংস্থান নির্দেশনা কেন্দ্রের একজন শিক্ষক মনে করেন, কম্পানি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পেশাদার পরামর্শ ক্লাস আছে। এসব ক্লাসে  ধীরে ধীরে একটি উপযোগী চাকরি খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। তাই শিক্ষার্থীরা কাজটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। তারা আত্মসমালোচনা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিজেদের শক্তিশালী দিকগুলো খুঁজে বের করে এবং কর্মসংস্থানের জন্য কীভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে ও উপস্থাপন করতে হবে, তা জানে। কর্মসংস্থানসংশ্লিষ্ট পরামর্শক্লাস শিক্ষার্থীদের আরও দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলছে।

তালিয়ান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক লিয়াং খেয়াল করেন যে, অনেক কম্পানি শিক্ষার্থীদের এই খোঁজ-খবর নেওয়ার বিষয়টাকে পছন্দ করে। কারণ, তারা মনে করে, শিক্ষার্থীরা কম্পানি সম্পর্কে যত বেশি জানবে, তত কম্পানির প্রতি আকৃষ্ট হবে। কম্পানির সবল দিকগুলো সম্পর্কে সম্ভাব্য কর্মী বা কর্মকর্তারা যত বেশি জানবে তত ভালো। এতে সেরা শিক্ষার্থীরা কম্পানি সম্পর্কে আগ্রহী হবে ও কম্পানি ভালো কর্মী পাবে। এতে চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগেই কর্মপ্রার্থীদের মধ্যে কম্পানি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে, যা সুবিধাজনক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষক বলেন, শিক্ষার্থীদের উচিত যুক্তিসঙ্গতভাবে কম্পানি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া।  এতে করে তারা তাদের নিজেদের সবলতা ও দুর্বলতা এবং কম্পানির চাহিদা ও কর্মপরিবেশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে। এর ফলে তারা যথেষ্ট জ্ঞান নিয়েই কর্মজীবনে প্রবেশ করার সুযোগ পায়, তা একটি প্লাস পয়েন্ট। তা না হলে, একটা অজান-অচেনা কম্পানি কাজ করতে গিয়ে শুরুতে অনেক সমস্যার সম্মুখীণ হতে হয়। নতুন জায়গায় খাপা খাওয়ানোর একটা ব্যাপার থাকে। যদি শিক্ষার্থীরা কম্পানি সম্পর্কে আগেভাগেই পর্যাপ্ত তথ্য পেয়ে যায়, তবে খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি সহজ হয়ে যায়।

বার্ষিক আয়, কাজের সময় ও কাজের চাপ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী অনেক শিক্ষার্থী। এ অবস্থায় ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াও অসম্ভব নয়। এ সম্পর্কে শিক্ষক ইয়ুর পরামর্শ হলো, ‘নদীতে সাঁতার কাটা শেখা প্রয়োজন।’ যদি বিভিন্ন কম্পানি বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ পাওয়া যায়, তবে তা আরও ভালো। ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করার চেয়ে সরাসরি কাজ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় সবসময়ই বেশি কার্যকর। ইন্টার্নশীপের মাধ্যমে কম্পানি কাজে পরিবেশ, কর্মীদের সঙ্গে কম্পানির আচরণ, ইত্যাদি সহজে বোঝা যায়।(সুবর্ণা/আলিম)