করোনা মহামারির দুঃসময়কে পিছনে ফেলে বাংলা নববর্ষ ১৪২৯কে সাড়ম্বরে বরণ করেছে বাংলাদেশের মানুষ। গত দু’বছর অন্য সবকিছুর মতো হতে পারেনি বাংলা নববর্ষ বরণের উৎসবও। বন্ধ ছিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী প্রভাতি অনুষ্ঠান। হতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ঐতিহ্যবাহী মঙ্গলশোভাযাত্রা। মহামারি-মৃত্যুতে গোটা জাতি ছিল অবরুদ্ধ দশায়।
করোনা পরিস্থিতির লক্ষ্মণীয় উন্নতি হওয়ায় এবার চিরচেনা রূপে ফিরেছে উৎসব-পাগল বাঙালির বর্ণাঢ্য বর্ষবরণ উৎসব। রমনার বটমূল মুখরিত হয়েছে ছায়ানটের প্রভাতি সংগীত-মূর্চ্ছনায়। চারুকলার ঐতিহ্যবাহী মঙ্গলশোভাযাত্রা ছড়িয়েছে রং আর প্রাণপ্রাচূর্যের বিভা! বাংলা একাডেমিতে বসেছে কারুপণ্য মেলা। ভোর থেকে দিনমান মানুষজন ঐতিহ্যবাহী লাল-সাদা পোশাকে সজ্জিত হয়ে যোগ দিয়েছে বৈশাখী আয়োজনে। করোনা অতিমারির দু’বছর পর আবার যেনো জেগে উঠে রাজধানী, গোটা দেশ।
রমনার বটমূলে ১৯৬৭ সালে শুরু হওয়া ছায়ানটের বৈশাখ আবাহন বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অবিচ্ছেদ এক অনুষঙ্গে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং করোনার দু’বছর ছাড়া কখনো বন্ধ ছিল না এ অনুষ্ঠান। তাই এবার ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ছিলো দুঃসময় পার হয়ে নব আনন্দে জাগার আহ্বান। ভোর ৬টা ১৫ মিনিটে রামকেলি রাগের সুরমূর্চ্ছনা আর নতুন সূর্যকিরণ মুক্তির আনন্দ নিয়ে এসেছে মানুষের মনে।
রবীন্দ্র, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত- এ পঞ্চকবির পাশাপাশি হাসন-লালনের গান এবং আবৃত্তিসহ আড়াই ঘন্টার অনুষ্ঠানে ছিল ৩৪টি পরিবেশনা। ছায়ানটে সভাপতি সনজীদা খাতুনের ধারণকৃত বক্তব্য ও তার কণ্ঠে নব আনন্দে জাগো গানটি উৎসবে প্রাণ সঞ্চার করে।
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ চারুকলার মঙ্গলশোভাযাত্রা। ‘নির্মল কর, মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে’- প্রতিপাদ্যে মঙ্গলশোভাযাত্রাটি বরবারের মতোই ছিল বর্ণাঢ্য। রংবেরঙের মুখোশ, টেপা পুতুল, মাছ ও পাখির প্রতিকৃতি এবং আবহমান বাংলার লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান বর্ণবিভা যোগ করে মঙ্গলশোভাযাত্রায়।
সকাল ৯টায় শোভাযাত্রাটি টিএসসি সড়ক দ্বীপ থেকে যাত্রা শুরু করে উপাচার্যের বাসভবনের কাছে স্মৃতি চিরন্তন ঘুরে আবার টিএসসিতে এসে শেষ হয়। পুলিশের নিরাপত্তা কড়াকড়ি সত্ত্বেও এবারের মঙ্গলশোভাযাত্রায় অংশ নেন বহু মানুষ। তবে চারুকলার সামনের রাস্তাটি দিয়ে মেট্রোরেলের পথ যাওয়ায় আগের মতো সেখান থেকে শুরু হতে পারেনি মঙ্গলশোভাযাত্রা। এতে শোভাযাত্রার শ্রীহানি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। রাজধানীর পাশাপাশি ৪৯৩টি উপজেলায় একযোগে হয়েছে মঙ্গলশোভাযাত্রা।
এর বাইরে বাংলা একাডেমিতে বিসিক নকশাকেন্দ্র, শিল্পমন্ত্রণালয় ও একাডেমির যৌথ আয়োজনে হয়েছে বৈশাখী মেলা। পুলিশের পক্ষ থেকে ২টায় অনুষ্ঠান শেষ করার কথা বলা হলেও সারাদিনই নববর্ষ উদযাপন করেছে রাজধানীর মানুষ।
বাংলা নববর্ষ আবাহনে সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ছাড়াও রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব। নববর্ষের আয়োজনকে ঘিরে বড় আকারের একটা অর্থনৈতিক লেনদেন হয়ে থাকে। স্থানীয় পণ্যের বিষয়ে মানুষ আগ্রহী হয় বলে গ্রামীন অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠে বৈশাখকে কেন্দ্র করে। বৈশাখী অর্থনীতি বলে একটা নতুন টার্মই চালু হয়েছে গত কবছর ধরে।
বৈশাখে উদপযাপনে প্রধান বিষয় পোশাক-আশাক। এ ছাড়া মিষ্টান্ন, আসবাব, ইলেকট্রনিক্সের চাহিদাও বাড়ে এ সময়।
ফ্যাশন হাউসগুলো তিন চার মাস আগে থেকেই নতুন নকশার পোশাক-আশাকে তোলার প্রস্তুতি নেয়। বাংলাদেশ ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতির ২০১২ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশের ফ্যাশন হাউসগুলোতে বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার বেচাবিক্রি হয়। এর মধ্যে ৫০ ভাগই হয় রোজার ঈদে। ২৫ ভাগ হয় পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ বৈশাখী অর্থনীতি দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।
তবে করোনায় গত দু’বছর বৈশাখী বাজার একেবারেই জমেনি। এবার জমার কথা থাকলেও রোজা এবং ঈদের কারণে বেশির ভাগ ক্রেতাই বৈশাখের চেয়ে ঈদকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। কারণ মূল্যস্ফীতি, আয়-রোগজগার কমে যাওয়ায় অনেকের পক্ষেই বৈশাখ এবং ঈদের জন্য আলাদাভাবে কেনাকাটা করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ফ্যাশন হাউসগুলোও এমনভাবে পোশাকের নকশা করেছে যাতে বৈশাখ ও ঈদ দুটোতেই এক পোশাকে চালিয়ে দেওয়া যায়।
তবে, গত দুবছরের চেয়ে ভালো হলেও সব মিলিয়ে যতটা আশা করা হয়েছিল নববর্ষে এবার ততটা ভালো বিক্রি হয়নি। কিন্তু বৈশাখ আর ঈদ দুটি মিলিয়ে করোনার পূর্ববর্তী বছরগুলোর চেয়ে বেশি, নিদেন পক্ষে সমান হবে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।