চীনের পাহাড়াঞ্চলের সিনিয়র সংগীত শিক্ষক তেং সিয়াও লানের গল্প
2022-04-12 09:20:17

১৯ মার্চ বিকেলে ৭৯ বছর বয়সী ম্যাডাম তেং সিয়াও লান চীনের হ্যপেই প্রদেশের ফুপিং জেলার মালান গ্রামে সংগীত উত্সবের প্রস্তুতিকাজের সময় সেরিব্রাল ইনফ্রাকশনে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ২১ মার্চ রাতে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন। আজকের অনুষ্ঠানে ম্যাডাম তেং সিয়াও লানের গল্প তুলে ধরবো।

 

২০২১ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শিশু-গায়কদের সাক্ষাত্কার নেওয়ার জন্য সংবাদদাতা হ্যপেই প্রদেশের ফুপিং জেলার মালান গ্রামে যান। সেই সময় ক্লাসের সংগীত শিক্ষক তেং সিয়াও লানের সাথেও পরিচয় হয় তার। তিনি সারা জীবন পাহাড়াঞ্চলের বাচ্চাদের সংগীত শিখিয়ে এসেছেন।

 

১৯৪৩ সালে, তখনও গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সেই যুদ্ধের সময়ে তেং সিয়াও লানের জন্ম। তাঁর বাবা ‘চিনছাজি দৈনিক পত্রিকা’-র সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ পত্রিকা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সংশ্লিষ্ট খবর ও প্রতিবেদন প্রকাশ করতো। তাই জাপানি আগ্রাসকদের গ্রেফতার ও তদন্ত এড়াতে তিনি গোপনে পত্রিকার কাজ করতেন। সেই সময়ের কথা স্মরণ করে ম্যাডাম তেং চোখের পানি ফেলেন। তিনি বলেন, একবার জাপানি বাহিনী তার বাবার গোপন আস্তানার কাছাকাছি চলে আসে। তখন স্থানীয় গ্রামবাসীরা বাবাকে রক্ষা করার জন্য লড়াই করেন ও ১৯ জন প্রাণ হারান। সেই সময় ম্যাডাম তেং জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা জাপানি সৈন্যদের গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে যান এবং পালিয়ে যাওয়ার রাস্তায় পাহাড়াঞ্চলের একটি জরাজীর্ণ ঘাসের চালায় তেং সিয়াও লান জন্মগ্রহণ করেন।

 

অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও বাবা-মায়ের বিপ্লবী কাজের বিপদের কারণে যখন পত্রিকার অফিস আবার হস্তান্তর করতে হয়, তখন বাচ্চা তেং সিয়াও লান ফুপিংয়ের একটি গ্রামের পরিবারের সাময়িক সদস্য হয়ে যান। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর তিনি আপন বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসেন। তাই ফুপিং তেংয়ের জন্য দ্বিতীয় জন্মস্থানের মতো।

 

২০০৩ সালে যখন তিনি আবার মালান গ্রামে ফিরে যান, তখন স্থানীয় বাচ্চাদের সাথে তার দেখা হয়। সেই সময় বাচ্চাদের সাথে গান গাইতে চান তিনি। তবে স্থানীয় গ্রামের ছাত্রছাত্রীরা কোনো গান গাইতে পারতো না, তাদের স্কুলে কোনো সংগীতের ক্লাস নেই। তিনি এ দৃশ্য দেশে অনেক মন খারাপ করেন। তখন থেকে পাহাড়াঞ্চলের বাচ্চাদের গান বা সংগীত শেখানোর সিদ্ধান্ত নেন তেং।

 

২০০৪ সাল থেকে তিনি প্রতিবছর কয়েক মাস করে মালান গ্রামে কাটাতে শুরু করেন। সেখানকার বাচ্চাদের গান গাওয়া ও বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখাতে থাকেন তিনি। ধীরে ধীরে বাচ্চারা অনেক গান শিখতে পেরেছে। ম্যাডাম তেং মনে করেন, সংগীতের শিক্ষা বাচ্চাদের সারা জীবন কাজে লাগবে। এ সম্পর্কে তিনি বললেন, গান ও কবিতা মানবজাতির সংস্কৃতির সবচেয়ে সুন্দর ও সেরা বিষয়। তাই সংগীত শিখলে বাচ্চাদের আবেগ ও অনুভূতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন হবে, চরিত্র আরো প্রাণচঞ্চল ও উন্মুক্ত হবে। সংগীতের শিক্ষক থাকলে গ্রামাঞ্চলের বাচ্চারা শহরের বাচ্চাদের মতো অনেক কিছু শিখতে পারবে।

 

একবার মালান গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে শাংহাই মহানগরের একটি আন্তর্জাতিক ইউথ সংগীত ক্যাম্পের অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। তখন কনসার্টের শেষ দিকে সবাই একসাথে ‘friendship all way long’ গানটি গায়। বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা মালান গ্রামের বাচ্চাদের সাথে এই গানটি গাইতে চায়, তবে তারা জানতো না চীনা গ্রামাঞ্চলের বাচ্চারা ইংরেজি গানের কথা জানে কিনা, তখন ম্যাডাম তেং আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দিয়ে বলেন যে, ‘আমাদের বাচ্চারা এ ইংরেজি গান শিখেছে, তারা চমত্কারভাবে গান গাইতে পারে।’ তখন থেকে মালান গ্রামের বাচ্চাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়। যে কোনো ধরনের অনুষ্ঠানে তারা নির্ভয়ে গান গাইতে পারে। এ গল্প স্মরণ করে ম্যাডাম তেংয়ের চোখ অনেক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

 

২০০৬ সালে ম্যাডাম তেং মালান প্রাথমিক স্কুলে একটি সংগীত দল গঠন করেন। তখন থেকে তিনি উপযুক্ত বাচ্চাদের বেছে নিয়ে তাদের আরো বেশি সংগীতের জ্ঞান শিখিয়ে দেন। বাচ্চাদের সংগীতের প্রতি আগ্রহ তৈরিতে তিনি মনোযোগ দিয়ে কাজ করেন।

 

২০০৮ সালে বেইজিং গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসের পর তিনি নিজের খরচে সংগীতদলের সদস্যদের বেইজিংয়ে ভ্রমণ করান এবং তাদের নিয়ে বেইজিংয়ের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে যান। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি বাচ্চাদের নিয়ে আমার বাড়িতে থাকি, আমার স্বামী তাদের জন্য রান্না করেন। তাদের কেবল গান গাওয়া বা বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখা নয়, বরং বাইরের দুনিয়ার দৃশ্য আরো বেশি দেখা ও অনুভব করা প্রয়োজন।’

 

ধীরে ধীরে তাঁর সংগীতদলের ৬ জন বাচ্চা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন। তবে তেংয়ের সংগীতদল অব্যাহতভাবে চলছে, আরো বেশি বাচ্চা এ সংগীতদলের সদস্য হয়েছে। শুরুর দিকে তিনি প্রতি মাসে একবার মালান গ্রামে আসতেন। পরে তিনি সংগীতদলের সদস্যদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে দেখে, গ্রামে আরও বেশী সময় কাটানো শুরু করেন। কেউ কেউ তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার বয়স হয়েছে, কেন এতো মনোযোগ দিয়ে কাজ করেন? ভ্রমণ করতে পারেন!’তিনি উত্তরে বলেন, মালান গ্রামের বাচ্চাদের খুশি তাঁর জন্য সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার। মালান গ্রামে যাওয়া-আসা তাঁর জন্য ভ্রমণের মতো মজার ব্যাপার।

 

২০১৩ সালে জার্মান বনাঞ্চল সংগীত উত্সবের খবর জানতে পারেন তেং। তখন তিনি ভাবেন সংগীত পাহাড় ও বনাঞ্চলে ভেসে যায় এবং মানুষের মনকে সমৃদ্ধ করে। এমন সুযোগ মালান গ্রামের বাচ্চাদের উপভোগ করা উচিত। তখন তিনি মালান গ্রামের পাহাড়াঞ্চলের একটি জলপ্রপাত খুঁজে বের করেন এবং সেখানে সহজসরল মঞ্চ স্থাপন করেন। সেখানে একটি সংগীত কনসার্ট আয়োজন করেন তিনি এবং আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের তা উপভোগ করতে আমন্ত্রণ জানান।

 

এ কনসার্টের সফল আয়োজন মালান গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপক উত্সাহ যোগায়। টানা কয়েক বছরের চর্চায় ২০২২ সালে বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ পায় তারা। মনোযোগ ও সাহসের সাথে গান গেয়েছে বাচ্চারা, যা সারা বিশ্বের দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। শীতকালীন অলিম্পিক গেমস শেষ করার পর তিনি আগের মতো আবার মালান গ্রামে ফিরে যান এবং স্থানীয় সংগীত উত্সবের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।

 

তবে সেরিব্রাল ইনফ্রাকশনের কারণে বাচ্চাদের কাছ থেকে তাকে চিরদিনের মতো বিদায় নিতে হয়। এ সম্পর্কে তেংয়ের ছেলে-মেয়ে বলে, ‘আমাদের মা জীবনের শেষ ১৮ বছর ধরে ফুপিং জেলার মালান গ্রামের শিশুদের সংগীত শিখিয়েছেন। এ অভিজ্ঞতা তাঁর জন্য আনন্দদায়ক ছিল। বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের সময় মালান সংগীতদলের বাচ্চাদের গান ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেটিও তাঁর জন্য সবচেয়ে খুশির ব্যাপার ছিল। এমন মূহুর্তে তিনি শান্তভাবে দুনিয়ার অন্য প্রান্তে চলে গেছেন। তবে সেটি আমাদের জন্য সান্ত্বনার ব্যাপার। আশা করি তিনি আনন্দের সাথেই স্বর্গে থাকবেন।’

 

অনেক বছর আগে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে তেং বলেছিলেন, চাঁদ তাঁর মনে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কারণ নদীতে, আকাশে যে-কোনো স্থানে চাঁদ দেখা যায়। তার বড় আশা বাচ্চাদের জন্য চাঁদের আকারের একটি মঞ্চ তৈরি করবেন। তাঁর এ স্বপ্ন স্বর্গে বাস্তবায়িত হবে এবং চাঁদের আলো বাচ্চাদের সুউজ্জ্বল ভবিষ্যতের সাথে থাকবে।

ইয়াংচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা ছবি এঁকে বসন্তকে স্বাগত জানায়

বসন্তকাল চলে এসেছে, দক্ষিণ চীনের চিয়াংসু প্রদেশের ইয়াংচৌ শহরে ব্যাপক ফুল ফুটেছে। ইয়াংচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্রী ছেন থিয়ান ই এবং ছেন চে সুয়ান অন্যদের মতো কেবল বসন্তকালের সুন্দর ফুলের ছবি তোলে না, তারা চিত্রকলার মাধ্যমে বসন্তের আমেজ তুলে ধরে।

 

অবসর সময়ে দু’জন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় হাঁটিহাটি করতে পছন্দ করে। ক্যাম্পাসের নানান জায়গার সৌন্দর্য ধরে রাখা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাদের হাতে আঁকা ‘উদ্ভিদ গাইড’-ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের নেভিগেশন মানচিত্রে পরিণত হয়েছে। অনেকে গাইড নিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় বৈশিষ্ট্যময় উদ্ভিদ খুঁজতে চেষ্টা করেন।

 

মেয়ে ছেন থিয়ান ই’র ‘উদ্ভিদ গাইড’ ছবিতে ভিন্ন ধরনের উদ্ভিদের প্রজাতি ও আকার তুলে ধরা হয়েছে, মজার কার্টুন ছবির মাধ্যমে সেগুলোর নাম ও অবস্থান বলে দেওয়া হয়েছে। এভাবে সহপাঠীরা সহজে উদ্ভিদ খুঁজে বের করতে পারে এবং উদ্ভিদ সম্পর্কে জ্ঞানও অর্জন করতে পারে। তাদের ব্যস্ত পড়াশোনার জীবনে এতে কিছুটা আরাম হয় এবং মানুষ ও প্রকৃতির সুষম সহাবস্থানও তারা অনুভব করতে পারে।

 

মেয়ে ছেন চে সুয়ান বলে, ‘কান্টিনের পাশে উইস্টেরিয়া। এর ফুল ছোট, আঙ্গুরের মতো। আমাদের স্ব-অধ্যয়ন ভবনের বাইরে সাদা রঙয়ের ম্যাগনোলিয়া, তার সুগন্ধ আমার বেশ ভালো লাগে।’

যখন তারা ফুলের ছবি আঁকে, তখন ভিন্ন ধরনের উদ্ভিদের কাঠামো, আকার নিয়ে আলোচনা করে থাকে। মেয়ে ছেন থিয়ান ই বলে, ছোটবেলা থেকে সে ছবি আঁকতে পছন্দ করে। মহামারীর কারণে সবাই শুধু ক্যাম্পাসে যাওয়া-আসা করে, বাইরে বেড়ানোর সুযোগ অনেক কম। তাই আশেপাশের সৌন্দর্য ধরে রাখতে চেষ্টা করে তারা এবং ক্যাম্পাসের সুন্দর দৃশ্যের সাথে অন্যদের পরিচয় করিয়ে দেয়।

সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)