বন্ধুরা, কল্পনা করুন, যদি পানি ও ভূমি ক্ষয় হয়, শস্য চাষ করা কঠিন হয়, যদি বছরে মানুষ শুধুমাত্র ৩৩ ইউয়ান অর্থাত্ ৫শ টাকারও কম আয় করে, তাহলে কীভাবে সুন্দর জীবনযাপন করা সম্ভব হবে? এমন স্থানের কোনো আশা আছে কি? আজ আপনাদের সঙ্গে চীনের এমন একটি জায়গার লোকজনের জীবনের কথা জানাবো। আমরা দেখবো, কীভাবে এমন জায়গার লোকজন দরিদ্রতা থেকে বের হয়ে এসেছে।
চীনের কুই চৌ প্রদেশের বি চিয়ে শহরটি ইয়ুন নান, কুই চৌ এবং সি ছুয়ান- এই তিন প্রদেশের মাঝখানে অবস্থিত। ওই অঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত আছে: মোরগ ডাকলে তিন প্রদেশের লোক শুনতে পায়। এটিই হলো বি চিয়ে শহরের ভৌগলিক অবস্থান।
ইয়ুন নান এবং কুই চৌ শহরে মালভূমি বেশি, কার্স্ট (karst landform ) ভূমিরূপ খুব সাধারণ ব্যাপার। এই কারণে সেখানকার জমি চাষাবাদের উপযোগী নয়। কোনোভাবেই পানি সংরক্ষণ করা যায় না। তাই লোকজন এমন জমিতে চাষাবাদ কারতে পারে না।
বি চিয়ে শহরের হাই ছুয়েই গ্রাম কার্স্ট ভূমি এলাকায় অবস্থিত। বনভূমির হার ৫ শতাংশেরও কম। গত শতাব্দীর ৮০ দশকে, গ্রামের ১৬৮টি পরিবারের সবাই ছিল দরিদ্র। মাথাপিছু আয় ছিল শুধু মাত্র ৩৩ ইউয়ান অর্থাত্ ৪৫০ টাকা।
অতীতে হাই ছুয়েই গ্রামের লোকজন এমন জরাজীর্ণ বাড়িঘরে থাকত। স্থানীয় লোকজন তাকে ‘চা চা বাড়িঘর’ হিসেবে উল্লেখ করত। মানে কয়েকটি কাঠ দিয়ে বাড়িঘরের কাঠামো তৈরি করতো, এতে ঘাস রেখে একটি বাড়ি বানানো যেতো। এমন বাড়িঘর কীভাবে তীব্র বাতাস ও বৃষ্টি প্রতিরোধ করবে?
১৯৮৫ সালে সাংবাদিক গ্রাম পরিদর্শন করেন, গ্রামের দরিদ্রের অবস্থা সবাইকে হতবাক করে দেয়। ১১টি পরিবারে সবই হতদরিদ্র। খাবার জন্য তেমন কিছু নেই। তারা দেখেছেন মিয়াও জাতির বৃদ্ধা আন মেই চেনের গায়ের পোশাকও নেই। পুরো পরিবারে চারজনের শুধু তিনটি বাটি ছিল। সাংবাদিক তখন স্থানীয় দরিদ্রতার সমস্যা নিয়ে খবর প্রকাশ করেন।
১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রীয় পরিষদ বি চিয়ে-এর দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য দারিদ্র্যবিমোচন পরীক্ষা এলাকা স্থাপনের অনুমোদন দেয়। তা হলো ‘উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন করা, প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়ন’কেন্দ্রিক পরীক্ষা চালানো। কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিভিন্ন বিভাগের সমর্থনে, হাই ছুয়েই গ্রামে ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করা হয়। তিন বছর কঠোর চেষ্টার পর ৮০ লাখ বর্গমিটারেরও বেশি পাইন গাছ চাষ করা হয়, আগের পাহাড় এখন সবুজ হয়ে উঠেছে।
হাই ছুয়েই গ্রামের সিপিসির শাখা সম্পাদক ওয়েন চেং ইউ বলেন, আগে আমাদের গ্রামের অবস্থা ছিল এমন- আবাদ করলে মানুষ আরও দরিদ্র হয়, দরিদ্র হলে আরও বেশি আবাদ করে। এখন আমাদের এখানকার পানি ও জমির মান ভালো হয়েছে, খাদ্য উত্পাদনের পরিমাণ অনেক গুণ বেড়েছে। আপেল চাষ করেছি, মাশরুম চাষের গ্রিনহাউস স্থাপন করেছি, পশুর খামার স্থাপন করেছি, গ্রামবাসীদের আয় বেড়েছে। ২০১৬ সালে পুরো গ্রাম দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে।
বি চিয়ে শহরে ছেং মান ইউয়ান নামে একটি গ্রাম আছে, গ্রামের নামের চীনা অর্থ হল- পুরো বাগানে কমলা। কেন এই নাম রাখা হয়েছে?
ছেং মান ইউয়ান গ্রামে চারটি ঋতুতে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের কমলা। গ্রামের আগের নাম ছিল নান কুয়ান গ্রাম। আগে গ্রামের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ২শ’ ইউয়ান। তাই লোকজন সবাই বলে, নান কুয়ান গ্রাম, প্রতি বছর জীবন খুব কঠিনভাবে কাটায়।
গ্রামের বাসিন্দা চাও লিয়ান ছুয়ান জানান, আগে তাঁর পরিবার ভুট্টা চাষের মাধ্যমে জীবনযাপন করত। অনেক কষ্ট করে জমি আবাদ করার পর বৃষ্টির পানিতে সব ধুয়ে যেত। সারা বছর পরিশ্রম করে মাত্র অর্ধের বছরের জন্য শস্য পাওয়া যেতো।
গত শতাব্দীর ৯০ দশকে, কৃষিবিজ্ঞান কর্মীদের সহায়তায়, কৃষকরা ভূট্টা চাষ থেকে ফল গাছ চাষাবাদের চেষ্টা শুরু করে। পুরো বাগানের ফল গাছ শুধু পানি ও জমি সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় কাজ হয় এবং শিল্পের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্য বাস্তবায়ন হয়, আর্থিক মুনাফা লাভ করার সুযোগ হয়।
এখন পুরো গ্রামে ৫০ লাখ বর্গমিটারের ফল বাগান আছে, প্রতি বছর ১ কোটি কেজি ফল পাওয়া যায়। পুরো বছর যে কোনো দিন আপনি গ্রামে যান, সে সময় গাছের তাজা ফল খেতে পারবেন।
স্থানীয় লোকজন মানুষ এবং প্রকৃতির বৈরিতা থেকে উভয়ের কল্যাণের পথ তৈরি করেছে। পরীক্ষামূলক দরিদ্র এলাকায় সার্বিক সচ্ছল সমাজ গঠনের জন্যও খুব ভালো একটি চেষ্টা।
২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর, কুইচৌ প্রদেশ সার্বিকভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হয়। এর মাধ্যমে পুরো দেশের ৮৩২টি দরিদ্র জেলা দারিদ্র্যমুক্ত হয়। ২০১৭ সালের জুন মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দেশের চরম দরিদ্র এলাকার দারিদ্র্যবিমোচন আলোচনা সভায় বিশেষ করে বি চিয়ে শহরের দারিদ্র্যমুক্তকরণের কথা উল্লেখ করেন, যা অর্থনীতির উন্নয়ন এবং সমাজের উন্নয়নের সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের একটি ভালো দৃষ্টান্ত।