বন্ধুরা, চীন ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস আছে। দুই দেশই বীর ও শহীদের সম্মান করে। অনেকে ধারণা করেন, যুদ্ধের মাঠে পুরুষ সেনারা যান, তারাই মারা যান। চীনের মুক্তিযুদ্ধে অনেক নারী যোদ্ধাও ছিলেন। তারা নিজেদের মতো করে ভূমিকা রেখেছিলেন। আসন্ন ৫ এপ্রিল চীনের ঐতিহ্যবাহী ছিং মিং উত্সব, অর্থাত্ এই উত্সবে চীনারা পূর্বপুরুষদের স্মরণ করেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান, তাদের সমাধি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। এমন উত্সবে আমরা এমন অসংখ্য বীর ও শহীদের স্মরণ করি। আজ আপনাদের জানাবো চীনের মুক্তিযুদ্ধে কয়েকজন নারীর অসাধারণ অবদানের গল্প।
চীনের ই মেং পাহাড়ি এলাকা ছিল চীনের বিপ্লব ও মুক্তিযুদ্ধের এক প্রধান মাঠ। যখন ‘ই মেং পাহাড়ের গান’-এর সুর বাজে; তখন মানুষের স্মৃতিও যেন যুদ্ধের সময় ফিরে যায়। স্থানীয় লোকজনের মনে, ‘ই মেং ছয় বোন’ এবং ‘ই মেং মাতা’ এবং ‘ই মেং ভাবীর’ গল্প সবসময় মানুষকে মুগ্ধ করে।
ই মেং পাহাড়ি এলাকার তুং সিন চুয়াং গ্রামের তিন পাশে নদী, আর নদীর বাইরে পাহাড়। ইতিহাসে জায়গাটি ‘যুদ্ধের শেষ মাঠ’ হিসেবে পরিচিত। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার আগে জাপানি আগ্রাসন-বিরোধী যুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট পার্টির সান তুং শাখা এবং অষ্টম রুট বাহিনীর প্রথম শাখা তুং সিন চুয়াংয়ে পরিচালনাকেন্দ্র স্থাপন করে জাপানি আগ্রাসন-বিরোধী যুদ্ধের নির্দেশনা দেয়। তাদের প্রধান অফিস ছিল সিপিসির সদস্য ওয়াং হুয়ান ইয়ু’র বাসায়। তখন বাহিনীর সঙ্গে এসেছিল ২৭জন সেনা শিশু। সবচেয়ে ছোট শিশুটি তিন দিন আগে জন্মগ্রহণ করে।
‘ই মেং মাতা’ হিসেবে পরিচিত নারী শহীদ ওয়াং হুয়ান ইয়ু’র নাতনি ইয়ু আই মেই বলেন, তখন ওয়াং হুয়ান ইয়ু শিশুদের অবস্থা দেখে খুব মন খারাপ করেন। তিনি প্রস্তাব দেন যে এসব শিশুকে গ্রামবাসীদের বাসায় আলাদাভাবে লালন-পালন করা যায়। শিশুদের ভালোভাবে যত্ন নেওয়া যুদ্ধের কাজে সাহায্য করবে।
যারা শিশুদের লালনে দক্ষ, তাদেরকে রাজি করানোর জন্য সিপিসি’র সদস্য হিসেবে ওয়াং হুয়ান ইয়ু সবার আগে ৭টি শিশুকে বাসায় নেন। গ্রামবাসীরা মাত্র ৫ দিনের মধ্যে সব ২৭টি শিশুর যত্ন নেয়ার ব্যবস্থা করে।
নাতনি ইয়ু আই মেই বলেন, তখন জীবনযাপনের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তাহলে কীভাবে এতগুলো শিশুর যত্ন নেওয়া যাবে? তখন তাঁর দাদি ওয়াং হুয়ান ইয়ু বলেন, এসব শিশুদের কারও বাবা-মা যুদ্ধে মারা গেছে। গ্রামের শিশুরা ভুট্টার মতো শস্য খায়। নিজের শিশু ক্ষুধায় কাঁদে, তবুও তারা শহীদের শিশুর যত্ন নিতে সব ভালো জিনিস দেয়, মাতৃদুগ্ধ দেয়, কিন্তু নিজের শিশুদের দেয় না। ইয়ু আই মেই তখনকার কথা মনে করে বলে, তখন তাঁর পরিবার চারটি শিশু ছিল, তবে পুষ্টির অভাবে সবাই বাঁচতে পারে নি।
ওয়াং হুয়ান ইয়ু এমন জরাজীর্ণ প্রাঙ্গণে অষ্টম রুট বাহিনীর সেনার শিশুদের যত্ন নেন। তাই লোকজন তাঁকে সম্মান করে ‘ই মেং মাতা’ ডাকে। ই মেং এলাকায়, ‘লাল ভাবী’ কোনো নির্দিষ্ট নারী নয়, বরং এক গোষ্ঠীর মানুষ। তারা মাতৃদুগ্ধ দিয়ে বিপ্লবের বিজয় লালন করেছিল, তাঁরা হাতে টানা গাড়ি দিয়ে ইতিহাসের গতি জোরদার করেছিল। তাঁরা আগ্রাসন প্রতিরোধ এবং জনগণের মুক্তির কবিতা রচনা করেছিলেন।
১৯৪৭ সালে জাপানের আগ্রাসন-বিরোধী যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ইতিহাসের বিখ্যাত এক যুদ্ধ মেং লিয়াং কু যুদ্ধ শুরুর এক দিন আগে, সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ চালানোর জন্য ই মেং পাহাড়ের দক্ষিণাঞ্চলের ওয়েন নদীতে একটি সেতু তৈরি হয়। যাতে সেনাবাহিনী সুষ্ঠুভাবে নদী অতিক্রম করতে পারে। তখন লি কুই ফাং নামে নারী এবং গ্রামের অন্য ৩২জন নারী নিজের বাড়িঘরের দরজা খুলে ঠান্ডা পানির নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাঁরা নিজের শরীর দিয়ে এই সেঁতু তৈরি করেন!
তুং সিয়ান ছুন হলেন সেতু তৈরিতে অংশগ্রহণকারী নারী লি কুই ফাং-এর নাতনি। তিনি বলেন, তখন সেনারা নারীদের কাঁধে পা দিয়ে নদী পার হন। তারা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সেনাদের রক্ষা করতে যান। তখন লি কুই ফাং বলেন, সময় মানে বিজয়, কমরেডস, আপনারা আমাদের কাঁধে পা দিয়ে নদী পার হয়ে যান।
ই মেং পাহাড়ি এলাকার নারীরা দৃঢ় সংকল্প দিয়ে দেশ এবং বাড়ি রক্ষার ইতিহাস তৈরি করেছেন। বিশেষ করে স্থানীয় ইয়ান চুয়াং গ্রামের ‘ই মেং ছয় বোনের’ গল্প সবার কাছে পরিচিত। তাঁরা পুরো গ্রামের নারীদের নেতৃত্ব দিয়ে যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে অবিচ্ছিন্ন সমর্থন দিয়েছেন।
‘ই মেং ছয় বোনের’ অন্যতম ইয়াং কুই ইং-এর মেয়ে কুং আই মিন বলেন, তখন তাঁর মা বলেছিলেন, গ্রামের সব পুরুষ যুদ্ধের মাঠে গিয়েছেন। ৬০, ৭০ বয়সের বৃদ্ধও ছড়ি হাতে সিপিসি সেনাদের পথ নির্দেশনা দিতে সাহায্য করেছেন। তাঁরা সবাই সিপিসি’র সদস্য। তাহলে গ্রামের কাজও তাঁদের নিজের কাজ।
চীনাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে যা প্রয়োজন, ই মেং ছয় বোন তা তৈরি করে দিতেন। তাঁরা পুরো গ্রামের নারীদের নিয়ে সেনাদের জন্য ৮০ হাজার কেজি রুটি রান্না করেছেন, এ ছাড়া তাঁরা আহতদের যত্ন নেন, সামরিক সামগ্রী পাঠান, সেনাদের পোশাক ধুয়ে দেন। সৈন্যের জন্য ৫ শতাধিক জুতা হাতে তৈরি করেছেন। তাঁরা দিন রাত ধরে সেনাদের জুতা তৈরি করেছেন, পায়ে ও বাহুতে অনেক রক্তনালী ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, হাতের আঙুলও বিকৃত হয়েছে।
বিপ্লব ও মুক্তিযুদ্ধের সময় ই মেং পাহাড়ি এলাকার জনসংখ্যা ৪২ লাখ। তাদের মধ্যে ১২ লাখ যুদ্ধের কাজে সমর্থন দিয়েছে। ২ লাখ সেনা বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ১ লাখ সেনা যুদ্ধ মাঠে প্রাণ উত্সর্গ করেছেন।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছিলেন, বিপ্লব অনেক কষ্টের অর্জন। সিপিসি ও জনগণ পরস্পরকে সমর্থন দিয়েছে। সিপিসি জনস্বার্থকে শীর্ষস্থানে রেখেছে এবং জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে বিপ্লব সাধন করেছে। জনগণ সিপিসির প্রতি বিশ্বাস রাখে।
ই মেং পাহাড়ি এলাকার বিপ্লবের গল্প হলো চীনা জনগণের অভিন্ন মানসিক সম্পদ। যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানবজাতিকে উত্সাহ দিয়ে আসছে।