চীনের মহাকাশকেন্দ্র ও ‘থিয়ানকুং ক্লাস’ সমাচার
2022-03-28 17:32:57

গত ২৩ মার্চ ছিল চীনের শেনচৌ-১৩ নভোচারীদের মহাকাশে অবস্থানের ১৫৯তম দিন। আর কিছুদিন পর এই ৩ চীনা নভোচারী চাই চি কাং, ওয়াং ইয়া পিং এবং ইয়ে কুয়াংফু’র মহাকাশজীবন শেষ হবে। তাঁরা ৬ মাসের জন্য মহাকাশে গিয়েছেন। ইতোমধ্যেই কেটে গেছে ৫ মাসের বেশি।

নভোচারীরা এর আগেও চীনের থিয়ানকুং মহাকাশকেন্দ্র থেকে ভূপৃষ্ঠে অবস্থানরত চীনা কিশোর-কিশোরীদের জন্য বিশেষ ক্লাস নিয়েছেন। এ ক্লাসের উদ্দেশ্য মহাকাশ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানাশোনা ও আগ্রহ বৃদ্ধি করা। নভোচারীরা মহাকাশকেন্দ্রে বসে ক্লাস নিয়েছেন এবং পৃথিবীতে ভিডিও-লিঙ্কের মাধ্যমে তা দেখেছে শিক্ষার্থীরা। চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর এবং তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী লাসা আর সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী উরুমুচির ক্লাসে বসে শিক্ষার্থীরা মহাকাশ সম্পর্কে অনেককিছু শিখেছেন।

এটা ছিল থিয়ানকুং মহাকাশকেন্দ্র থেকে নেয়া নভোচারীদের  দ্বিতীয় ক্লাস। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ বিশেষ ক্লাসের কিছু দিক তুলে ধরবো।

দ্বিতীয় ক্লাসের শুরুতে ৩ জন নভোচারী নিজেদের নাম-পরিচয় উল্লেখ করেন। এর পর থিয়ানকুং ক্লাসের দ্বিতীয় পাঠ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এবারের ক্লাসেও নারী নভোচারী ওয়াং ইয়া পিং আগের মতো চীনা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কয়েকটি মজার মহাকাশ-পরীক্ষা তুলে ধরেন এবং নভোচারী ইয়ে কুয়াংফু মহাশূন্য সম্পর্কে খানিকটা ধারণা দেন। আর অন্য নভোচারী চাই চি কাং তাঁদের ক্লাস লাইভ প্রচারের জন্য ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করেন।

মহাকাশকেন্দ্রে ‘বরফ ও তুষার’ তৈরির পরীক্ষা

২০২২ বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক গেমস ও প্যারালিম্পিক গেমসের কারণে চীনাদের মধ্যে বরফ ও তুষার ক্রীড়ার প্রতি আগ্রহ অনেক বেড়েছে। তাই শিক্ষক ওয়াং ইয়া পিং মহাশূন্যে ‘বরফ ও তুষার’ তৈরির পরীক্ষা প্রদর্শন করেন। তিনি এক হাতে একটি প্লাস্টিক ব্যাগ নেন। ব্যাগের ভিতরে সুপারস্যাচুরেটেড সোডিয়াম অ্যাসিটেট দ্রবণ আছে। ব্যাগের সাথে একটি স্ট্র যুক্ত আছে। তিনি খুব সাবধানে ব্যাগের ভিতর থেকে স্ট্র-র মাধ্যমে অল্প পরিমাণ তরল তুলে নেন। এর পর ধীরে ধীরে স্ট্র-র মুখে একটি ছোট স্বচ্ছ তরল বল দেখা যায়। তখন তিনি অন্য এক ধরনের জিনিস বলের সংস্পর্শে আনেন। হঠাত্ স্বচ্ছ বল একটি বরফের বলে পরিণত হয়। সেই দৃশ্য দেখে ছাত্রছাত্রীরা অনেক অবাক হয়ে যায়। এ পরীক্ষার ব্যাখ্যায় শিক্ষক ওয়াং বলেন, আসলে সুপারস্যাচুরেটেড সোডিয়াম অ্যাসিটেট দ্রবণ গরম পানিতে সহজে দ্রবীভূত হয়, তাই কেবল অল্প পরিমাণের স্ফটিক নিউক্লিয়াস কণা যুক্ত করে তা কম সময়ের মধ্যে স্ফটিক সৃষ্টি হয়।

মহাশূন্য স্টেশনের মাইক্রোগ্রাভিটি পরিস্থিতিতে তরল পৃষ্ঠটানের কারণে অভিন্ন তরল বল দেখা দেয়, তাই তরলের টানশক্তি বোঝাতে শিক্ষক ওয়াং দ্বিতীয় পরীক্ষা করেন। তিনি হাত দিয়ে দুটি প্লাস্টিক বোর্ড ধরেন এবং নভোচারী ইয়ে কুয়াংফু পানির ব্যাগ দিয়ে প্লাস্টিক বোর্ডের ওপর আলাদাভাবে একটি তরল বল লাগিয়ে দেন। তখন পৃথিবীর ক্লাসরুমের ছাত্রছাত্রীরাও এ ধরনের পরীক্ষা করছিল। মহাশূন্যে শিক্ষক ওয়াংয়ের হাতের দুটি তরল যুক্ত হবার পর তিনি যখন ধীরে ধীরে দু’দিক থেকে টানতে থাকেন, তখন একটি বিশেষ আকারের লম্বা তরল সেতুর মতো সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের হাতের তরল এমন দৃশ্য সৃষ্টি করে না। এ সম্পর্কে থিয়ানকুং বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য, বেইজিং চিয়াওথং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ছেন চেং ব্যাখ্যা করে বলেন যে, তরল সেতু কেবল মাইক্রোগ্রাভিটির পরিস্থিতিতে সৃষ্টি করা যায়, পৃথিবীতে গ্রাভিটির প্রভাবে বিশেষ উচ্চচাপের পরিবেশে তরল সেতু দেখা যেতে পারে।

বিংতুনতুন ও থিয়ানকুং ক্লাস

এবারের ক্লাসে ভাসমান পরীক্ষাও চালান মহাকাশের শিক্ষকরা। শিক্ষক ওয়াং একটি বোতলে পানি ও তেল রাখেন। পৃথিবীর ক্লাসরুমের ছাত্রছাত্রীরাও বোতলে পানি ও তেল রেখে ঝাকা দেয়। দেখা গেল মহাশূন্যে তেল ও পানি একসাথে মিশ্রিত হয়েছে। তখন শিক্ষক ইয়ে মহাশূন্যে দ্রুত বোতল ঘুরাতে থাকেন। দেখা গেল পানি ও তেল আলাদা হয়ে গেছে।

নভোচারীরা এবারের মহাশূন্য-যাত্রায় একজন বিশেষ অতিথি নিয়ে গেছেন। এই অতিথি হলেন বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের মাস্কট বিংতুনতুন। ক্লাসে বিংতুনতুনও বিশেষ ভুমিকা পালন করেছে। শিক্ষক ওয়াং বিংতুনতুনকে একদিকে ধাক্কা দিয়েছেন, তখন শিক্ষক ইয়ে অন্যদিকে দাঁড়িয়ে বিংতুনতুনকে ধরে ফেলেন। তারপর আবার ওয়াংয়ের কাছে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফিরিয়ে দেন। এভাবে দেখা গেল বিংতুনতুন দু’জনের মধ্যে অভিন্ন রৈখিক গতিতে যাওয়া-আসা করছে। মহাশূন্য স্টেশনের মাইক্রোগ্রাভিটির কারণে এমনটা ঘটে। এ অবস্থায় কোনো পদার্থের ওপর গ্রাভিটি কাজ করে না।

দুটি মজার পরীক্ষার পর চীনের মহাশূন্য স্টেশনের দুটি রহস্যময় বিজ্ঞান-পরীক্ষাগার ক্যাবিনেট প্রদর্শন করা হয়। নভোচারী শিক্ষকরা স্ক্রিন ও ভিডিওয়ের মাধ্যমে এ বিশেষ ক্যাবিনেটের ব্যবহার-পদ্ধতি বুঝিয়ে দেন। এমন পরীক্ষাগার ক্যাবিনেট বিজ্ঞান গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ টুল, যা চীনের মহাশূন্য বিজ্ঞানীদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির মহাশূন্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের পরিচালক চাং ওয়ে বলেন, চীনের মহাশূন্য স্টেশনে আরও অনেক বিজ্ঞান-পরীক্ষাগার ক্যাবিনেট থাকবে। এভাবে মহাশূন্যে বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালানো সম্ভব হবে।


এ সম্পর্কে নভোচারী ইয়ে বলেন, দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগার ক্যাবিনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা করতে পারেন। চীনের মহাশূন্য স্টেশন মানবজাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। তিনি ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিয়ে  চিন্তাভাবনা করতে উত্সাহ দেন।

এসময় ক্লাসরুমের ছাত্রছাত্রীরা মহাশূন্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আগ্রহ ও কৌতূহল প্রকাশ করে। তারা মহাশূন্য ক্লাসের শিক্ষকদের কাছে অনেক প্রশ্ন করেছে। যেমন: মানুষের অশ্রু মহাশূন্যে কী আকারের? অশ্রু কি লম্বা আকারের? এটা কি মহাশূন্য ভেসে থাকে? মহাশূন্য থেকে চাঁদ দেখতে কেমন? মহাশূন্য পানি কি ফুটানো যায়?

নভোচারীরা তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। অশ্রুসংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে নারী নভোচারী ওয়াং ইয়া পিং বিশেষ জবাব দেন। তিনি বলেন, “আমরা মহাশূন্য স্টেশনে অনেক দিন ধরে সময় কাটিয়েছি। তাই আমাদেরকে অশ্রু ঝরানোর মতো সময়ও কাটাতে হয়েছে। সেই সময় আমাদের অশ্রু পৃথিবীর মতো গাল বেয়ে নিচে নামেনি, চোখের কোণেই থেকে গেছে। পৃথিবীর মতো করে কাঁদা আসলে মহাকাশে সম্ভব নয়!”

মজার মজার পরীক্ষা ও ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নোত্তরে থিয়ানকুং ক্লাসের সময় দ্রুত পার হয়ে গেছে। ক্লাসের শেষ দিকে ৩ জন নভোচারী সবার কাছ থেকে বিদায় নেন এবং ছাত্রছাত্রীদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান।

নভোচারী ইয়ে কুয়াংফু বলেন, “চীনের মহাশূন্য কতর্ব্য আর অসীম মহাশূন্যের অনুসন্ধান কাজ আমাদের অবিরাম স্বপ্ন। চীনের মহাশূন্য কর্তব্যের উন্নয়ন যুব ছাত্রছাত্রীদের পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করবে। তাই ছাত্রছাত্রীরা কৌতূহল ও ভালোবাসা নিয়ে ভালভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান অর্জন করবে বলে আশা করি।”

নারী নভোচারী ওয়াং ইয়া পিং বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনুসন্ধান কাজ অনেক মজার ও চমত্কার ব্যাপার; ছাত্রছাত্রীরা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে আরো বেশি সুন্দর মহাশূন্য স্টেশন নির্মাণ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এবারের ক্লাসের একজন ছাত্র আনন্দের সাথে ক্লাসের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলল, নভোচারীদের সাথে কথাবার্তা তার জন্য অতি স্মরণীয় ব্যাপার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি তার ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। বড় হয়ে সে মহাশূন্যের সাথে জড়িত মেজর বেছে নেবে, ভবিষ্যতে চীনের মহাশূন্য অনুসন্ধান কাজে নিজের অবদান রাখবে।  (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)