দু’বছর ধরে চলমান করোনা মহামারিতে বাংলাদেশের বহুমানুষ জীবিকা হারিয়ে দরিদ্র হয়ে পড়েছেন। দরিদ্ররা হয়েছেন হতদরিদ্র। বহু মানুষকে কাজ করতে হচ্ছে কম মজুরিতে।
২০২০ সালের জুনে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এক জরিপে জানায় করোনায় ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে। তবে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি অব গভর্ন্যান্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট এবং পাওয়ার এন্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের এক যৌথ জরিপে বলা হয়েছে করোনায় বাংলাদেশে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস এন্ড জাস্টিসের (সিপিজে) ২১ মার্চ প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে করোনা প্রভাবে গত বছরের জুনে আয় কমে যায় ৬৪ শতাংশ মানুষের। গত ডিসেম্বের কিছুটা কমেও তা ছিল ৫৩ শতাংশে। এ সময়ে কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন ৩৩ শতাংশ মানুষ। ২৬ শতাংশ মানুষকে জীবননির্বাহ করতে হয়েছে সঞ্চয় ভেঙে।
গত বছরের জুনে ঋণ করতে হয়েছে ৬৬ শতাংশ পরিবারকে- যদিও ডিসেম্বরে এ হার অনেকটা কমে ডিসেম্বরে তা দাঁড়ায় ৩৪ শতাংশে। আর পরিবারগুলোকে ঋণের টাকার ৩২ শতাংশ ব্যয় করতে হয়েছে খাদ্যদ্রব্য কেনায়।
এমন একটা পরিস্থিতিতে বাজারে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। একদিকে আয়-উপার্জন কমে যাওয়া এবং অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ।
এ পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যের বাজারে লাগাম টানতে এবং রোজাকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষকে একটু স্বস্তি দিতে সরকার ২০ মার্চ থেকে দেশে এক কোটি পরিবারকে ‘ফ্যামিলি কার্ডের’ মাধ্যমে সাশ্রয়ীমূল্যে টিসিবি পণ্য দিচ্ছে সরকার। ঢাকা ও বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকা বাদে সারাদেশে দেওয়া হচ্ছে এ সব পণ্য।
এ কর্মসূচির আওতায় ১১০ টাকা দরে ২ লিটার তেল, ৫৫ টাকা ধরে ২ কেজি চিনি, ৬৫ টাকা দরে ২ কেজি মসুর ডাল ও ৫০ টাকা দরে ২ কেজি ছোলা দেওয়া হচ্ছে কার্ডধারীদের। সরকারের এ উদ্যোগের ফলে দরিদ্র পরিবারগুলো কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছে। এ জন্য সরকারে এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।
কিন্তু, এমন চমৎকার কর্মসূচিতে নানা ধরনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে।
প্রথম যে অভিযোগটি উঠেছে তা হলো- অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত দরিদ্র পরিবারটি পায়নি ফ্যামিলি কার্ড। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের অনুগ্রহভাজনদের ভাগ্যে জুটেছে কার্ড- যাদের অনেকের হয়তো এ কার্ডের দরকারই নেই।
দ্বিতীয় যে অভিযোগটি উঠেছে তা হলো- কার্ড নিয়ে লাইনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত অনেককে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। এ ছাড়া কখন টিসিবির কোনো ট্রাক কোথায় দাঁড়াবে তা সবসময় হলপ করে বলা যায় না। ফলে মানুষজনকে ট্রাকের পিছনে ছুটতে গিয়ে গলদগর্ম হতে হচ্ছে।
শুধু সারাদেশে টিসিবি পণ্য পেতে যে এ সব সমস্যা তা নয়। খোদ রাজধানীতেই টিসিবি পণ্য নিয়ে এন্তার অভিযোগ। প্রথম দিকে ২ লিটার তেল, ২ কেজির মসুর ডাল, ২ কেজি চিনি, ৫ কেজি পেঁয়াজের প্যাকেজ মিলেছে ৬১০ টাকায়। এখন এর সঙ্গে ৪ কেজি ছোলা ও ২ কেজি খেজুর যোগ করে প্যাকেজ বিক্রি হচ্ছে ৯৭০ টাকায়।
এ সব পণ্য পেতেও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে মানুষজনকে। অনেক জায়গায় লাগছে স্থানীয় কাউন্সিলরদের কথিত টোকেন। টোকেন ছাড়া লাইনে দাঁড়িয়েও মিলছে না পণ্য। কিন্তু টিসিবি থেকে রাজধানীতে কোনো টোকেন সিস্টেম করা হয়নি। এটি স্থানীয় কাউন্সিলরদের দায় বলে, নিজেদের দায় এড়াচ্ছে টিসিবি।
এর বাইরে এক প্যাকেজে অনেকগুলো পণ্য থাকায় মানুষকে বাধ্য হয়ে অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় পণ্যটিও কিনতে হচ্ছে। এ ছাড়া ২ কেজি ছোলা ও এক কেজি খেজুর বিক্রির কথা থাকলেও অনেক জায়গায় টিসিবির ডিলাররা ৪ কেজি ছোলা ও ২ কেজি খেজুর গছিয়ে দিচ্ছে। এ নিয়েও রয়েছে অসন্তোষ। কারণ অনেকের কাছে ছোলা আর খেজুর বর্তমানে সময়ে রীতিমত বিলাস দ্রব্য। আর অনেকের পক্ষে ৯৭০ টাকা যোগাড় করাও কঠিন ব্যাপার।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী পত্রিকান্তরে সাক্ষাৎকারে টিসিবি পণ্য বিক্রিতে কিছু অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন। তবে ৫০ জন পণ্য পায়নি, শুধু এটি না লিখে, আড়াই শো জন যে ন্যায্যমূল্যে পণ্য পেয়েছেন তাও লিখতে সাংবাদিকদের পরামর্শ দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
বাণিজ্যমন্ত্রী মহোদয়ের পরামর্শ শিরোধার্য করেও এটা বলা যায়, রাজধানীসহ সারাদেশে টিসিবি পণ্য বিক্রিতে দেশের মানুষ আরও সুনীতি ও সুব্যবস্থাপনা প্রত্যাশা করে। সরকার নিশ্চয় এ বিষয়ে নজর দেবেন।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।