ইউক্রেনসহ বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বায়ো ল্যাবে আসলে কি চলছে?
2022-03-25 20:03:40

গত বুধবার রুশ উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জীবাণু কার্যক্রম নিয়ে রাশিয়া উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের মারাত্বক অণুজীবের পরীক্ষা না দেখার ভান করতে পারে না রাশিয়া।

 

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশে অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে উচ্চ মাত্রার ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেছে। সেসব ল্যাবে তারা মানুষের জিনগত উপাদান সংগ্রহ, এবং বিশ্লেষণ করছে। রাশিয়া এসব উপেক্ষা করতে পারে না

 

যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ট ডেট্রিক সামরিক ঘাঁটি ও ইউক্রেনসহ সারা বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশে ৩০০টিরও বেশি জৈব ল্যাবে আসলে কি চলছে? মার্কিন ইতিহাসবিদ জেফ্র এস কায়ে সম্প্রতি চীনের গ্লোবাল টাইমস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সেসব স্থানে গোপণ জৈবাস্ত্র প্রকল্প চালাচ্ছে বলে আমি মনে করি”।  এই ইতিহাসবিদ দীর্ঘকাল ধরে কোরীয় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জীবাণু  অস্ত্র ব্যবহারের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি তার মানসিক ক্লিনিকে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার নির্যাতনের শিকারদের সাহায্য করেছেন। তার রচিত ‘কাভার আপ এট গুয়ানতানামো’ বইয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রকাশিত দলিল প্রমাণ করেছে, কোরীয় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জৈব অস্ত্র ব্যবহার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বাস্তবতা আড়াল করতে চেয়েছিল এবং ‘জৈব অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি’ অনুযায়ী তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে আসছে।

 

 ইউক্রেনসহ নানা দেশে যুক্তরাস্ট্রের জৈব পরীক্ষাগার সম্পর্কে তিনি বলেন, সে সব পরীক্ষাগারে অনেক গোপন তথ্য রয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন সংঘর্ষ শুরুর পর ইউক্রেনের জৈব পরীক্ষাগারের সংশ্লিষ্ট দলিল ধ্বংস ও স্থানান্তর করা হয়েছে। মার্কিন সরকার হয়ত বলতে পারে যে, বিদেশে তাদের জৈব পরীক্ষাগারের প্রধান কাজ ছিল বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বর্তমান প্রাণীর হুমকি মোকাবিলা করা। তবে বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশের জৈব অস্ত্র পরিকল্পনা নিয়ে  গবেষণা করেছেন যারা, তারা জানেন, সে পরীক্ষাগারের গবেষণা প্রতিরক্ষার নয়, হামলার জন্য।

 

তিনি বলেন, “কোরীয় যুদ্ধের ইতিহাস তদন্তের সময় আমি বহু বার লক্ষ্য করেছি, জৈব অস্ত্র গবেষণা কথিত ‘প্রতিরক্ষামূলক জৈব অস্ত্র গবেষণা’র অজুহাতে পরিচালিত হয়েছে”।

 

তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র কি আড়াল করতে চায়? তা সঠিকভাবে আমরা জানি না। তবে আমরা জানি যে, যুক্তরাষ্ট্র কিসের বিরোধিতা করে। দীর্ঘকাল ধরে যুক্তরাষ্ট্র “জৈব অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি’-এর অধীনে তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা গঠনের বিরোধিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র। যার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছামতো তত্পরতা চালাতে পারে এবং তা নিরীক্ষা করা যায় না।

 

ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের জৈব পরীক্ষাগার সম্বন্ধে গত সোমবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র চাও লি চিয়ান বেইজিংয়ে এক নিয়মিত সাংবাদিক সম্মেলনে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনে যে ফাইল, ছবিসহ বিভিন্ন প্রমাণ পেয়েছে, তার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র শুধু ‘ভুয়া তথ্য’ শব্দটি উচ্চারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র আসলে কাউকেই তার জবাব বিশ্বাস করাতে পারেনি।

 

জানা গেছে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গত শুক্রবার সম্মেলন আয়োজন করে ইউক্রেনের জৈব নিরাপত্তা সমস্যা নিয়ে আলাপ করেছে।

 

এই সম্বন্ধে চীনা মুখপাত্র চাও লি চিয়ান বলেন, বর্তমানে উন্মুক্তভাবে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনে দশটিরও বেশি জৈব পরীক্ষাগার মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে। এসব পরীক্ষাগারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ২০ কোটিরও বেশি মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট গবেষণার উদ্দেশ্য হল মারাত্মক ভাইরাসের গুপ্ত সংক্রমণ ব্যবস্থা স্থাপন করা। এক রুশ কর্মকর্তার বরাতে চীনা মুখপাত্র  জানান, রাশিয়া ইউক্রেনে ৩০টিরও বেশি যুক্তরাষ্ট্রের জৈব পরীক্ষাগার আবিস্কার করেছে। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলো জরুরীভাবে বন্ধ করা হয়েছে, তবে প্লেগ রোগ, অ্যানথ্রাক্সসহ বিভিন্ন ভাইরাসের লক্ষণ পাওয়া গেছে। মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড স্বীকার করেছেন যে, ইউক্রেনে ‘জৈব গবেষণা স্থাপনা’ আছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সঙ্গে সহযোগিতা করছে, তবে এসব গবেষণা সামগ্রী রাশিয়ার হাতে পড়বে না।

 

মার্কিন তথ্যমাধ্যম জানিয়েছে, ইউক্রেনে গুপ্ত জৈব পরীক্ষাগারের বিষয়ে মার্কিন সরকার মিথ্যা বলেছে, জনগণকে এসব পরীক্ষাগারকে সমর্থন করার আসল উদ্দেশ্য জানায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোম্যধে ইউক্রেনে গণস্বাস্থ্য পরীক্ষাগারে রাখা বিপজ্জনক ভাইরাসকে ধ্বংস করার প্রস্তাব দিয়েছে। চীনা মুখপাত্র চাও লি চিয়ান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ‘উন্মুক্ত এবং স্বচ্ছ’ দেশ হিসেবে নিজেকে আখ্যায়িত করে, যদি যুক্তরাষ্ট্র একে ‘ভুয়া তথ্য’ বলে, তাহলে কেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে না? যুক্তরাষ্ট্রের বরাদ্দ করা ২০ কোটি মার্কিন ডলার কোথায় ব্যবহৃত হয়েছে? যুক্তরাষ্ট্র কি কি ভাইরাস নিয়ে কি কি গবেষণা করেছে? ইউক্রেনে মার্কিন দূতাবাস তার ওয়েবসাইটে সব সংশ্লিষ্ট ফাইল ডিলিট করেছে, তারা কি লুকিয়ে রাখতে চায়? যুক্তরাষ্ট্র কেন ২০ বছর ধরে ‘জৈব অস্ত্র নিষিদ্ধ কনভেনশন’-এর আওতায় বহুপক্ষীয় পরীক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের বিরোধিতা করে? যুক্তরাষ্ট্র কেন এসব জৈব পরীক্ষাগারকে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের স্বাধীন তদন্তের জন্য উন্মুক্ত করে না?

চাও লি চিয়ান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ায় দ্বিচারিতা ছিল। ২০০৫ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউক্রেনের স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ইউক্রেনের স্থাপনার সমস্ত কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে। তবে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের নির্ধারিত ‘স্পর্শকাতর তথ্য’ প্রকাশ করতে পারে না। ২০২১ সাল শেষে ‘জৈব অস্ত্র নিষিদ্ধ কনভেনশন’ স্বাক্ষরকারী দেশের সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের দাখিল করা দলিল অনুযায়ী, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের ২৬টি জৈব পরীক্ষাগারসহ বিভিন্ন সহযোগিতামূলক স্থাপনা আছে। চাও লি চিয়ান বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্রের নিজের প্রকাশিত তথ্য পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সমাজ কিভাবে বিশ্বাস করতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্র সত্যিকার অর্থে ‘জৈব অস্ত্র নিষিদ্ধ কনভেনশন’ পালন করছে? চীনা মুখপাত্র চাও লি চিয়ান আরো বলেন, এত বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় অন্য দেশকে নিয়ম মেনে চলতে এবং স্বাধীন পরীক্ষা চালানোর সুযোগ দিতে চাপ দিয়ে আসছে। এসব অজুহাতে অন্য দেশের ওপর শাস্তি আরোপ বা আক্রমণ করেছে। তবে কেন যুক্তরাষ্ট্র নিজে স্বাধীন পরীক্ষাকে ভয় পাচ্ছে? এটি আসলে মার্কিন স্টাইলের দ্বৈত মানদন্ড।

 

মুখপাত্র আবারও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়িত্বশীল মনোভাব নিয়ে সামরিক কর্মকান্ডের সার্বিক ব্যাখ্যা দান এবং  ‘জৈব অস্ত্র নিষিদ্ধ কনভেনশন’-এর পরীক্ষা ব্যবস্থার বিরোধিতা না করার তাগিদ দেন। তিনি বলেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আন্তর্জাতিক সমাজের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য এবং বিশ্বের জৈব নিরাপত্তা মান বাড়ানোর জন্য সহায়ক হবে। (রুবি/এনাম)