গত সপ্তাহের অনুষ্ঠানে আমরা জানিয়েছিলাম ‘অ্যা লাইফলং জার্নি’ নামে চীনের একটি সিরিজ টিভি নাটকের দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার গল্প। এই টিভি সিরিজ চীনা লেখক লিয়াং সিয়াও শেংয়ের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে রিমেক করা হয়েছে। টিভি সিরিজ দর্শকদের মধ্যে সমাদৃত হওয়া সাথে সাথে উপন্যাসের বই বিক্রিও বেড়েছে। যা এখন ‘বেস্ট সেলার’ বুকের তালিকায় রয়েছে। আজকের এ অনুষ্ঠানে এ টিভি সিরিজের পরিচালক লি লু’র সঙ্গে পরিচিত হবো।
প্রথমে, লি লু এক নিঃশ্বাসে ‘অ্যা লাইফলং জার্নি’ উপন্যাসটি পড়ে শেষ করেছিলেন। উপন্যাসে ‘মানুষের গভীরতায়’ উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। যা বাস্তববাদী থিমযুক্ত শিল্পকর্ম তৈরি করার গভীর ইচ্ছাকে জাগরণ করেছে। তারপরে, উত্তর-পূর্বের একটি ছোট শহরে লি লু ‘অ্যা লাইফলং জার্নি’ নামে এ টিভি সিরিজ তৈরি করেছেন।
তাই ৫০ বছর ধরে বিস্তৃত একটি চীনা পরিবারের মহাকাব্যিক চিত্র ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছিল। উত্তর চীনের একটি ছোট শহর, এক দল ব্যস্ত মানুষের মধ্যে বিশ্বের হাজার বছরের জীবনশৈলী দেখানো হয়।
‘অ্যা লাইফলং জার্নি’ নামের উপন্যাস থেকে দেশীয় নাটকের বিকাশ এবং কীভাবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তা জনপ্রিয় হবে, সে সম্পর্কে পরিচালক লি লু’র গভীর ধারণা জন্মায়। ভবিষ্যতে আরও বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবেন তিনি। তিনি বলেন, মানুষের আবেগকে সঠিক অর্থে উপস্থাপন করা এবং বাস্তব গল্পগুলো ভালোভাবে বলা সহজ ব্যাপার নয়, তবে চীনা গল্প ভালোভাবে বলার জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় পদ্ধতি।
‘অ্যা লাইফলং জার্নি’ নামের এ সিরিজ টিভি নাটক গত ২৮ জানুয়ারি থেকে প্রচারিত হচ্ছে। এরপর থেকে তা বিভিন্ন স্তরের দর্শকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছে। টিভি চ্যানেলে প্রচার সম্পন্ন হওয়ার পর এ নিয়ে আলোচনা কখনও বন্ধ হয়নি।
এ প্রসঙ্গে লি লু বলেন, এ টিভি নাটক সার্বিকভাবে দর্শকদের মুগ্ধ করতে পারে- যা আগে ভাবিনি। অনেকে বলেন, এ টিভি নাটকটি দেখার পর চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কারণ অশ্রুতে চোখ ধুয়ে যায়। সবচে বাস্তব সত্য জানার পর আমাদের চোখ খুলে যায়।
এত মনোমুগ্ধকর পরিচালনা প্রক্রিয়ায় পরিচালক হিসেবে লি লু’র অনুভূতি কেমন ছিল?
এই প্রশ্নের জবাবে লি লু বলেন, আসলে আমি কান্নাকাটি পছন্দ করি না। দৈনন্দিন জীবনেও আমি খুব কম কাঁদি। তবে এ টিভি নাটক শুটিং করার সময় মাঝে মাঝে আমার চোখ ভিজে উঠেছে। অনেক দৃশ্য-বিন্যাস দেখে আমি আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি। আমি মনে করি, আসলে টিভি নাটকের ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য-বিন্যাস প্রত্যেকের জীবন বা অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যেমন, কিছু লোকের আশেপাশের আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুরা কর্মচ্যুত হন, কিছু লোকের পরিবারের সদস্য রোগাক্রান্ত হয়ে বা বিভিন্ন কারণে মারা যান, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি তথা ঘৃণা সৃষ্টি হয়। টিভি নাটকের সংশ্লিষ্ট দৃশ্যের মধ্যে মানুষ নিজেদের ছায়া দেখতে পায়।
পরিচালক লি লু বলেন, আমি ‘অ্যা লাইফলং জার্নি’ টিভি সিরিজ কাজে লাগিয়ে পিতামাতার পক্ষে কথা বলতে চাই এবং বর্তমান সমাজকে জাগিয়ে তুলতে চাই। এখানে পিতামাতার পক্ষ থেকে কি কি বলা হয়েছে?
জবাবে লি লু বলেন, যে বিষয়ে মানুষকে জাগ্রত করা হয় তা হলো- পরিবারের প্রতি আমাদের অনুভূতি এবং সমাজের দ্রুত বিকাশের কারণে মানুষের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া মমতার বন্ধন ও বন্ধুত্ব।
আগে প্রতিবেশীরা যখন একে অপরের বাসায় খেতে যেতো, তখন তাদের আগেভাগে জানানোর দরকার ছিল না। এখন সবাই একে অপরকে না জেনেই একই ভবনে থাকে। বহু বছর কেটে গেছে; আমাদের বন্ধুরা প্রায়ই একে অপরের সাথে দেখা করত, কিন্তু এখন আমরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বেশি যোগাযোগ করি। তারপর থেকে কত বছর কেটে গেছে?
বলা যায়, ‘অ্যা লাইফলং জার্নি’ নামে এ টিভি সিরিজে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের মঙ্গল ও সৌন্দর্য বড় করে দেখানো হয়। পরিচালক হিসেবে লি লু কি নিজের ইচ্ছায় এভাবে সাজিয়েছেন?
জবাবে লি লু বলেন, এটাই আমার সর্বদা অটুক থাকার বিষয়। আমি উষ্ণ নাটক পছন্দ করি। ‘অ্যা লাইফলং জার্নি’তে কোনো দুষ্টু মানুষ নেই, কেবল আছে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করা তুলনামূলক স্বার্থপর মানুষ। অবশ্যই তারা স্বার্থ ও সুখের জন্য কষ্ট করে, প্রতিবন্ধকতা আছে, দুঃখও আছে। তবে নাটকের মুল সুরও উষ্ণ।
এটাও হতে পারে আমার সমাজ পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি, অথবা সমাজের যে অবস্থা থাকা উচিত—উষ্ণতা ঠান্ডার চেয়ে বড়, মন্দের চেয়ে দয়া বড়, অন্ধকারের চেয়ে আলো বড় এবং এটি চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নাটকের মূলধারার অভিব্যক্তি হওয়া উচিত। উষ্ণতা, ইতিবাচক ও ভাল কাজের মূল সুর হলো চীনের বাস্তবতা এবং আমাদের প্রজন্মের চীনা জনগণের জীবনধারা।
আমরা এসব বিষয় সামনে রাখতে হবে। বিপরীত দিকে, কর্মক্ষেত্রে ষড়যন্ত্র এবং জীবনের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিষয় দর্শকদের জন্য উপস্থাপন করা হলে এসব বিষয় সমাজের প্রধান অভিব্যক্তিতে পরিণত হতে পারে- যা একটি খুব অদ্ভুত ঘটনা হবে। আমরা ইতিমধ্যে একটি কঠিন জীবন কাটাচ্ছি। কাজের চাপ ও জীবনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমাদের এমন কিছু বিষয়কে বড় করে দেখাতে হবে যা রৌদ্রোজ্জ্বল বা খারাপ এবং প্রত্যেকের দেখার ক্ষেত্রে মূল্যবোধের অভাব রয়েছে। আমি এটি পছন্দ করি না।
নিজেকে খুব উষ্ণ একজন মানুষ হিসেবে মনে করেন লি লু। তিনি বলেন, নিজের চরিত্রের কারণে আমি মানব প্রকৃতির উষ্ণতার প্রতি আরও মনোযোগ দিতে পারি। আমি সর্বদা অনুভব করি যে, আমি যে পৃথিবী দেখি তা বেশ ভাল, আমি আনন্দকে বড় করি না, আমি কেবল উষ্ণতা বৃদ্ধি করি।
এই টিভি নাটক দর্শকদের মধ্যে যা সমাদৃত হবে কিনা, সে বিষয়ে লি লু কি চিন্তিত ছিলেন?
এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি নিজের পরিচালিত টিভি নাটক নিয়ে সন্তুষ্ট। ২০১০ সালে যখন ‘Boss happiness’ নামের টিভি নাটকটি প্রচারিত হয়, তখন জনগণ ধীরগতির জীবন কাটাচ্ছিল। জীবনের সুখানুভূতি বাড়ানোর জন্য। ২০১৭ সালে ‘In the name of people’ নাটক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, সেই বছর দুর্নীতিদমন করা ছিল আলোচিত বিষয়। এ বছরে ‘অ্যা লাইফলং জার্নি’ নামের এ টিভি সিরিজে বিগত ৪০ ও ৫০ বছরের উষ্ণতার অতীত পর্যালোচনা করা হয়েছে। সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া এবং বর্তমানে চীনের সাফল্য সবই এ নাটকে ফুটে উঠেছে।
লি লু বলেন, পরিচালক হিসেবে যুগের কথা চিন্তা করতে হবে। সমাজ, যুগ ও দর্শকদের চিন্তাধারার ওপর দৃষ্টি না রাখলে দর্শকদের সঙ্গে একই আবেদন সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না। একজন পরিচালক হিসেবে আমাদের প্রথমে একজন পর্যবেক্ষক হতে হবে, তারপর একজন চিন্তাবিদও হতে হবে।
‘অ্যা লাইফলং জার্নি’ টিভি সিরিজে ক্রুরা শিল্পকলা, ফটোগ্রাফি থেকে শুরু করে কস্টিউম ও প্রপস ইত্যাদির বিষয়ে দারুণ চেষ্টা করেছেন। এই খুঁটিনাটি আন্তরিক বিষয়ে লি লু বলেন, আমি বরাবরই প্রত্যেক ক্রুকে বলেছি, নাটকের প্রত্যেক সাজসরঞ্জাম ও কস্টিউমের গল্প বলা যায় এবং অভিনয়ে অংশ নিতে হবে। আমাদের ক্রু সদস্যরা এক একজন সতর্ক বৃদ্ধ কারিগর। একটু একটু করে, অর্ধ শতাব্দী ধরে চীনাদের খাদ্য এবং পোশাকসহ জীবনের নানা সুনির্দিষ্ট বিষয় পুনরুদ্ধার করেছেন তাঁরা।
সম্প্রতি ডিজনি ‘অ্যা লাইফলং জার্নি’ নামে এ টিভি সিরিজ নাটকের চীনের বাইরের অঞ্চলে প্রচারের কপিরাইট কিনেছে। অ্যানিমেশনের জন্য বিখ্যাত একটি বিদেশি কোম্পানি চীনা বাস্তববাদের থিমযুক্ত টেলিভিশন নাটক কিনেছে।
এ ব্যাপারে লি লু বলেন, আগে এ খবর জেনে আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। তারপর আমি মনে করেছি, এটাই স্বাভাবিক।
আমি আগে বিবিসি’র সঙ্গে এসব বিষয়ে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। তারা বলেছে যে, ‘উ চে থিয়েন’ চীনের ইতিহাসে একমাত্র সম্রাজ্ঞী। তাঁকে নিয়ে কাজ করতে চায় বিবিসি। কারণ তাদের ইতিহাসেও এমন একজন সম্রাজ্ঞী ছিলেন। তারা ১৯৪৯ সালের পর চীনের শুটিং করা উ চে থিয়েন সংক্রান্ত সব মুভি ও টিভি নাটকের কথা বলেছে। বিভিন্ন শিল্পকর্মের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছে। আমি শুনেছি, ডিজনি শিল্পকর্ম নির্বাচন করার সময় খুব কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। তারা আমাদের এই শিল্পকর্ম বাছাই করেছে, তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, সারা বিশ্বে এই টিভি নাটকের বিস্তার নিয়ে আশাবাদী ডিজনি।
লি লু মনে করেন, সংস্কৃতির আমদানি এবং রপ্তানি সমান হতে হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমি পশ্চিমা জগতের অনেক ভালো চলচ্চিত্র, টিভি নাটক ও সংগীত আমদানি করেছি। এখন আমাদের ভালো শিল্পকর্ম তাদেরকে দেখানো উচিত।
ডিজনির এ টিভি নাটকের কপিরাইট কেনার খবর প্রকাশের সময় এ টিভি নাটকের মাত্র এক মাস শুটিং হয়েছিলো। খবর জানার পর লি লু ও তার দল আরো মনোযোগ দিয়ে তাদের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আমরা আশা করি, প্রতিটি শট, প্রতিটি লাইন, প্রতিটি দৃশ্যের একটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে এবং বিদেশি দর্শকরা যা দেখবে তা আমাদের ভাবতে হবে।
শুটিং করার সময় লি লু সবসময়ই সবাইকে মনে করিয়ে দিতেন যে, দেশি-বিদেশি দর্শকদের চীনের ৫০ বছরের সত্যিকার উন্নয়ন দেখাতে হবে। গোটা ক্রুদের জন্য এটি নতুন চাপ ও চালিকাশক্তি।
ডিজনি’র এ টিভি নাটকের কপিরাইট নিয়ে কিছুটা সন্দেহও রয়েছে। বিদেশিরা এটি বুঝবে কিনা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন কেউ কেউ। অন্যরা মনে করছে- এতে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। কারণ সর্বোপরি, এই নাটকটি আমাদের কিছু দুঃখজনক অতীতকে চিত্রিত করেছে।
মানুষের উদ্বেগ নিয়ে লি লু বলেন, তিনি তা ভাবেন না। কারণ মানুষের আনন্দ, রাগ, দুঃখ ও সুখ, মন্দের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয়, সুখী জীবনের প্রতি সাধনা, এ বিষয়গুলো একই।
‘অ্যা লাইফলং জার্নি’ নামে এ সিরিজের স্পষ্ট থিম হলো ভালোবাসা। ভালোবাসা যুগের পটভূমি, নাগরিকত্ব, অঞ্চল বা বর্ণের’র সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এটি সবার হৃদয়ের কোমলতম অংশে লুকিয়ে আছে। এই ধরনের অনুভূতি অবশ্যই জাতীয় সীমানা এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্য অতিক্রম করতে পারে। এ বিষয়ে আমার কোনও উদ্বেগ নেই।
প্রকৃতপক্ষে, অনেক দেশের দুর্ভোগ নিয়ে ডিজনিতে অনেক কিছু প্রচার হয়েছে। আসলে আমাদের এই নাটকের মূল বিষয়বস্তু দুর্ভোগ নয়, বরং চীনা জনগণের সহনশীলতা ও শক্তি এবং চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের দুর্দান্ত সাফল্য। প্রাণবন্ত চরিত্রের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে চীনকে তুলে ধরা হয়েছে। চীন সম্পর্কে বিশ্বকে আরও জানানোর খুব ভাল সুযোগ এটি।
পরিচালক হিসেবে লি লু চীনাদের গল্প সারা বিশ্বকে জানানোর চেষ্টা করছেন।
আগে ‘In the name of people’ নাটক প্রচারিত হওয়ার সময় বিদেশি বংশোদ্ভূত চীনারা এবং বিদেশিরা তা পছন্দ করেন। তারা নাটকের কথোপোকথনও মুখস্থ বলতে পারতেন। তাই আমাদের চীনের সংস্কৃতি ও চীনের বাস্তব জীবন তুলে ধরার মাধ্যমে সত্যিকার ভালো বিষয়বস্তু তৈরি করতে হবে। আমাদের শিল্পকর্ম উপভোগ করার প্রক্রিয়াকে চীন স্বীকৃতি দেবে। একটি টিভি সিরিজ বা চলচ্চিত্র এবং একটি চরিত্র ও গল্প নীরবে-নিভৃতে আমাদের মূল্যবোধ ও বিশ্বাস পৌঁছে দেবে।
(লিলি/তৌহিদ)