২০২২ বেইজিং শীত্কালীন প্যারালিম্পিক গেমসের মাস্কট স্যুয়ে রং রংয়ের ডিজাইনারের গল্প
2022-03-21 17:06:59

২০২২ বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক গেমস ও প্যারালিম্পিক গেমস সাফল্যের সঙ্গে শেষ হয়েছে। গত দেড় মাসের মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশের খেলোয়াড়রা বেইজিংয়ে এসে অলিম্পিক গেমসে অংশ নিয়েছেন এবং খেলাধুলায় আগ্রহীদের জন্য সুন্দর প্রতিযোগিতা তুলে ধরেছেন। শীতকালীন অলিম্পিক গেমস বেইজিংয়ে হওয়ায় আমরাও কাছ থেকে শীতকালীন বরফ ও তুষার খেলার আমেজ অনুভব করেছি। মহামারীর কারণে স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার সুযোগ ছিল না। তবে, টেলিভিশন বা মোবাইল ফোনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার লাইভ অনুষ্ঠান দেখেছি।

এবার শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের দুটি মাস্কট ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এদের নাম পিংতুনতুন আর স্যুয়ে রং রং। অলিম্পিকে যারা পদক পেয়েছেন, তাদের সবার হাতে একটি সোনার পিংতুনতুন বা সোনার স্যুয়ে রং রং দেওয়া হয়েছে। স্যুয়ে রং রং প্যারালিম্পিক গেমসের বিশেষ মাস্কট। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা স্যুয়ে রং রংয়ের ডিজাইনারদের কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

গত ৪ মার্চ ২০২২ বেইজিং প্যারালিম্পিক গেমসের মাস্কট স্যুয়ে রং রংয়ের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের পরিচয় হয়। চীনের চিলিন শিল্পকলা একাডেমির ডিজাইনারদল ৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্যুয়ে রং রংয়ের ডিজাইনের কাজ করেছেন। ওই দিন রাতে ডিজাইনাররা একসাথে বেইজিং প্যারালিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপভোগ করেন এবং একসাথে স্যুয়ে রং রংয়ের সঙ্গে ছবি তোলেন। এ মুহূর্ত সবার জন্য স্মরণীয় ও তাত্পর্যপূর্ণ।

স্যুয়ে রং রংয়ের ডিজাইনে পুরোপুরি চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির উপাদান প্রতিফলিত হয়। দূর থেকে দেখলে তার চীনা লণ্ঠনের আকৃতি ফুটে ওঠে। তার মাথায় ‘রু’ই’ আকারের তুষার রয়েছে, যা চীনা ভাষায় সুখ বা শুভকামনার প্রতীক; মাথার ওপর শান্তির পায়রা মৈত্রীর প্রতীক; এবং শরীরে ঐতিহ্যিক কাগজ কাটা হস্তশিল্পের অস্তিত্ব।

স্যুয়ে রং রং একমাত্র মাস্কট যার মধ্য থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ে। শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের মাস্কট ইতিহাসে এমনটা এবারই প্রথম দেখা গেল। স্যুয়ে রং রংয়ের আলো কেবল লন্ঠনের বৈচিত্র্যের প্রতিফলন নয়, বরং প্যারালিম্পিক গেমসের অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের স্বপ্ন উজ্জ্বল করা এবং বিশ্বকে উষ্ণ করার প্রতীকও বটে। তাই মাস্কট হিসেবে স্যুয়ে রং রং মৈত্রী, সাহস ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা প্রতীক।

২৪ বছর বয়সের চিয়াং ইয়ু ফান স্যুয়ে রং রংয়ের ডিজাইনারদের অন্যতম। তার ডিজাইন ৬০০০টিরও বেশি ডিজাইনের মধ্য থেকে নির্বাচিত হয়। এটা তাঁর জন্য আনন্দদায়ক ব্যাপার। আসলে ২০১৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বেইজিং অলিম্পিক গেমস কমিটি ‘২০২২ বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক ও প্যারালিম্পিক গেমসের মাস্কট সংগ্রহ কার্যক্রম’ আয়োজন করে। তখন সারা বিশ্ব থেকে উপযোগী মাস্কট ডিজাইন সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০ দিন পর শিক্ষকদের সহায়তায় চিলিন শিল্পকলা একাডেমির ১০১টি ডিজাইন বেইজিংয়ের অলিম্পিক গেমস কমিটির হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেই সময় ছাত্রী চিয়াং ইয়ু ফান এ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করতেন। যখন শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের জন্য মাস্কট ডিজাইন করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি বিভিন্ন অলিম্পিক গেমসের মাস্কটের ডিজাইন সংগ্রহ করে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁটিয়ে দেখেন। তিনি খেয়াল করেন যে, আগের মাস্কটগুলোর  অধিকাংশই পশুপাখির আকৃতির। তাই তিনি তার প্রথম ডিজাইনে তিনি এলক বেছে নেন। তবে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই এলক দিয়ে ডিজাইন করেছেন। তখন শিক্ষক বলেন যে, সারা বিশ্বে এলকের তুষার বরফ ক্রীড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ তাত্পর্য রয়েছে, তাই এমন ডিজাইন স্বাভাবিক, অন্যান্য জিনিসও মাস্কট হতে পারে।

মেয়ে চিয়াংয়ের জন্মস্থান উত্তরপূর্ব চীনের হেইলংচিয়াং প্রদেশের ইছুন শহরের চিয়া’ইন জেলায়। প্রতিবছরের বসন্ত উত্সবে তার জন্মস্থানে প্রতিটি বাড়িতে বড় সাইজের লাল লন্ঠন ঝুলানো হয়। হঠাৎএ চিন্তাভাবনা তাকে অনুপ্রেরণা যোগায়। তিনি চীনা গিঁট ও লন্ঠন দিয়ে মাস্কট ডিজাইন করেন। স্যুয়ে রং রংয়ের মূল আকৃতি তখনই সৃষ্টি হয়। তবে পরে তিনি অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। ২০১৯ সালে বেইজিং অলিম্পিক গেমস কমিটির বিশেষজ্ঞদের অধিবেশনে মাস্কট ডিজাইনে ব্যাপক পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়া হয়। তার মানে কেবল মাস্কটের মূল আকার ও বৈশিষ্ট্য লন্ঠন বজায় রাখা হলেও, বিস্তারিত ডিজাইনে ব্যাপক সংশোধন করতে হবে।

এ সম্পর্কে স্যুয়ে রং রং ডিজাইনদলের সদস্য, চিলিন শিল্পকলা একাডেমির ডিজাইন বিভাগের উপ-প্রধান উ ই বো বলেন, সেই সময় বসন্ত উত্সবের ছুটি চলছিল। তাই ছুটিতে যাওয়া ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের বাড়ি থেকে ডেকে আনতে হয়। মাস্কট সংশোধনী দলের নামও রাখা হয় ‘১২৫ দল’।

অলিম্পিক কমিটির মাস্কট ডিজাইন গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ডিজাইনার দলের সদস্য মাত্র ১৭ জন। তারা দিন-রাত স্কুলের বিশেষ অফিসভবনে সংশোধনীর কাজ করে চলেন। বহু চিন্তাভাবনার পর খসড়া ডিজাইন আঁকা ও থ্রিডি ডিজাইনসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে ৩টি মাস্কট প্রস্তাব করা হয়।

১৮ দিন পর ডিজাইনার প্রতিনিধিদল ৩টি প্রস্তাব ও ৬২টি স্ক্যাচ নিয়ে বেইজিংয়ে পৌঁছান। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চীনা গিঁট ডিজাইন বাতিল করা হয়। এপ্রিল মাসে মাস্কটের মূল আকার লন্ঠন, পায়রা ও এলকের মধ্যে বহুবার পরিবর্তন ঘটানো হয়। মে মাসের শেষ দিকে অবশেষে লাল লন্ঠনের ডিজাইন বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এক বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে ডিজাইনার দল মোট ৩২টি প্রস্তাব দিয়েছে এবং তাতে স্ক্যাচের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। ডিজাইনার দল গ্রাফিক ডিজাইন,পণ্যের নকশা, কার্টুন ডিজাইন ও থ্রিডি মডেলসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে মাস্কট তৈরি করেছে।

মডেলও তৈরি হয় ডিজাইনার দলের নিজের উদ্যোগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বর্গমিটারের স্টুডিওকে অস্থায়ী কারখানায় রূপান্তরিত করা হয়। ৩ বর্গমিটারের ব্যালকনি পেইন্টিং কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। এ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে ডিজাইনাররা বলেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল লন্ঠন জ্বালানো এবং তাকে শীতকালীন প্যারালিম্পিক গেমসের সাথে যুক্ত করা।

এ সম্পর্কে চিলিন শিল্পকলা একাডেমির কার্টুন বিভাগের উপ-প্রধান চিয়াও ছিয়াং বলেন, ‘দীর্ঘকাল ধরে আমরা চেষ্টা করছি লন্ঠনের মধ্যে পশুপাখির ডিজাইন দিয়ে প্রাণ সঞ্চার করতে। এর অংশ হিসেবেই লন্ঠনের ওপর এলকের শিং বা পাখির ডানা যুক্ত করা হয়। তবে এমন ডিজাইনের মাস্কট দেখতে খুব একটা ভালো লাগেনি। পরে আমরা খেয়াল করি যে, এমন চিন্তাধারা সফল হবে না। ফলে আমরা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে লন্ঠনে পশুপাখির মূর্তি ব্যবহার করার চেষ্টা পরিত্যাগ করি। বরং লন্ঠনকে প্রাণচঞ্চল করার উপাদান যুক্ত করি। ২০১৯ সালের ২১ অগাস্ট আমাদের ডিজাইন প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর স্যুয়ে রং রং ২০২২ বেইজিং শীতকালীন প্যারালিম্পিক গেমসের মাস্কট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে লোকদের সামনে তুলে ধরা হয়। সেই সময় ডিজাইনার দলের সবাই আনন্দে কেঁদেছে। এ কাজের পিছনে কতো কষ্ট বা পরিশ্রম ছিল তা কেবল তারাই জানেন।’

এ মাস্কট ডিজাইনের পর সংশ্লিষ্ট ইমোজি ও পেরিফেরাল পণ্যের ডিজাইন কাজ শুরু করেন তারা। তাদের ডিজাইন ব্যাপক স্বীকৃতি ও প্রশংসা পেয়েছে। বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক কমিটির সাংস্কৃতিক ইমোজি বিভাগের পরিচালক লিন ছুন চেন বলেন, এ লন্ঠনের মূর্তি অনেক ভালো, দেখতে অনেক লাভলি। মাস্কট পর্যালোচনা কমিটির চেয়ারম্যান চিয়াং সিয়াও ইয়ু বলেন, স্যুয়ে রং রং চীনের সংস্কৃতি ও অলিম্পিক চেতনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে, যা চীনা সভ্যতা ও অলিম্পিক গেমসের প্রদর্শন এবং চীনা জনগণের অলিম্পিক গেমস ও বিশ্বের জন্য দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার।

এ মাস্কটের প্রধান ডিজাইনার মেয়ে চিয়াং বলেন, ‘স্যুয়ে রং রং আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ও লাভলি উপহার। ভবিষ্যতে ডিজাইনার হিসেবে কাজ করার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে।’ বর্তমানে মেয়ে চিয়াং ইয়ু ফান চিলিন শিল্পকলা একাডেমির ভিশন সম্প্রচার বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। ডিজাইন কাজ সম্পর্কে সে বলল, ‘একজন সেরা ডিজাইনার হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। তবে ভবিষ্যতে আরও সুন্দর ও সত্যিকারের শিল্পকর্ম তৈরিতে চেষ্টা করব।’(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)