পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র : বাংলাদেশ-চীনের যৌথ-উদ্যোগে অনন্য নজির
2022-03-20 19:44:01


বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার চীন। চীনের অর্থ ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশে অনেক বড় বড় অবকাঠামো গড়ে উঠেছে এবং এখনো বেশ কিছু প্রকল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। পদ্মাসেতু থেকে শুরু করে দেশে বেশিরভাগ মেগাপ্রকল্পে কোনো না কোনোভাবে রয়েছে চীনের অংশগ্রহণ। 


বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগের এক অনন্য নজির পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নানা দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। 


এ যাবত দেশে চালু হওয়া সবচেয়ে বড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রা। দু’দেশের যৌথ মালিকানায় নির্মিত হয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়েছে প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ। নির্ধারিত প্রকল্প ব্যয়ের চেয়ে কম অর্থ লেগেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে। বলা হচ্ছে দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে এত অল্প সময়ে এতবড় প্রকল্প দ্বিতীয়টি নির্মিত হয়নি। 

পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ অংশীদারিত্বে। বাংলাদেশ ও চীনের দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির সমান অংশীদারত্বে গঠিত বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) এটি নির্মাণ করেছে। এর আধাআধি অর্থাৎ ৫০ শতাংশ করে মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও চীনের চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)। 

এক হাজার একর জমির ওপর পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৪৭ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছে ২৩০ কোটি ডলার (প্রায় ১৯ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা)। প্রকল্পের ৮০ শতাংশ অর্থ এসেছে চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋণসহায়তা থেকে।

বিসিপিসিএলের তথ্যে জানা যায়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ নর্থওয়েস্ট পাওয়ার  জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরশনের (সিএমসি) মধ্যে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে চুক্তি স্বাক্ষর হয়।

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালীতে কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এটি উৎপাদনে আসে। ১৫ মে প্রথম ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে দিতে সক্ষম হয় বিসিপিসিএল। 

একই বছরের ২৬ আগস্ট উৎপাদনে আসে দ্বিতীয় ইউনিট। ৮ ডিসেম্বর আলট্রা সুপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্বিতীয় ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। কিন্তু গোপালগঞ্জ সাবস্টেশনের ধারণক্ষমতা কম থাকায় এবং গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকার আমিনবাজার পর্যন্ত সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এখন পর্যন্ত সরবরাহ করতে পারছে না বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। তবে এ বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে পুরো ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দিতে সক্ষম হবে এ পাওয়ার প্ল্যান্টটি।

পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এতসব ইতিবাচক দিকেরর বিপরীতে পরিবেশগত ঝুঁকির কথা বলে আসছেন পরিবেশবাদীরা। প্রতিদিন এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন হবে ১৩ হাজার মেট্রিক টন কয়লা। এ হিসেবে বছরে ৪০ লাখ টন কয়লা পোড়াতে হবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এতে পরিবেশের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। 

তবে, প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, এ কেন্দ্রে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে, যা পরিবেশবান্ধব সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। কার্বন নিঃসরণের হার পরিমাপ করে এখানে নিয়মিত পরিবেশদূষণ পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। 

পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৩তম দেশ হিসেবে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বলেও জানিয়েছে বিসিপিসিএল।

নির্ধারিত সময়ের আগে নির্মাণ কাজ শেষ হলেও করোনা মহামারির কারণে এতদিন কেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ মার্চ, সোমবার পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক–ই–ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এ দিন দেশের শতভাগ বিদ্যুতায়নেরও উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশ-চীনের যৌথ অংশীদারিত্বে নির্মিত পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দুদেশের উন্নয়ন-সহযোগিতায় এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ সামগ্রিক অর্থনীতি এবং বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কেও এটি বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এতে কনো সংশয় নেই। 


মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।