যুক্তরাষ্ট্রের ডাকাতির কবলে আফগান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ!
2022-03-10 14:29:23



 

যুক্তরাষ্ট্রে গচ্ছিত রাখা আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র জব্দ করে রাখে। এখন তা নিজেদের অর্থের মতো করে নানা খাতে বন্টন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ব পরাশক্তি। কিন্তু আফগান জনগণের অর্থ নিয়ে এমন কাণ্ডকে ‘ডাকাতি’ হিসেবে অভিহিত করছেন অনেক বিশ্লেষক।

 

গত বছরের আগস্টে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফিরে এসে একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। আফগানিস্তানের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার জন্য স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৭ বিলিয়ন ডলার জমা রেখেছিল। যে অর্থের মালিক একমাত্র আফগান জনগণ ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু তালিবান ক্ষমতায় আসার অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র এই অর্থ হাতিয়ে নেয়। অথচ সারা বিশ্ব জানে, তালিবানকে যুক্তরাষ্ট্রই দোহা চুক্তির মাধ্যমে বৈধতা দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং আফগানিস্তান থেকে নিজেদের নিরাপদ পলায়ন সুনিশ্চিত করেছে।  

 

যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে এই ৭ বিলিয়ন ডরার জব্দ করে। সর্বশেষ গত ১১ ফেব্রুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই অর্থ বিভিন্ন খাতে বন্টন করে একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এমন আদেশ বিশ্বকে অবাক করেছে। সেসঙ্গে আফগান জনগণকে মর্মাহত করেছে। কারণ বাইডেন কোনোভাবেই আরেকটি দেশের জনগণের অর্থ বন্টন করতে পারেন না। অনেকে আবার একে রীতিমতো ‘ডাকাতি’ বলে অভিহিত করছেন।

 

যুক্তরাষ্ট্র এই অর্থকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। এর কিছু অংশ কুখ্যাত ৯/১১ এর শিকারদের ক্ষতিপূরণে ব্যবহার করা হবে এবং বাকি অংশ আফগানিস্তানে ভবিষ্যতে মানবিক সহায়তার জন্য একটি ট্রাস্ট তহবিলে স্থানান্তর করা হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের আফগান অন্তর্বর্তী সরকার তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। আফগান সরকার বলেছে, প্রথমত, ৯/১১ ঘটনার পর ২০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। ঘটনার সাথে আফগান জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই এবং আফগানিস্তানের সবমানুষ এর মূল্য দিতে পারে না। ক্রমাগত যুদ্ধ এবং অস্থিরতা আফগানিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে। প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন আফগান সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। প্রায় ২৩ মিলিয়ন মানুষ চরম ক্ষুধার সম্মুখীন হয়েছে, যার মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩.২ মিলিয়ন শিশুও রয়েছে।

 

আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ কে দেবে?

 

আফগানিস্তানের সাথে আলোচনা ছাড়াই আফগান সম্পদ যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করতে পারে না। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ডাকাতি। এটি আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজাভের জন্য একটি বড় ধাক্কা। কারণ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই আফগানিস্তানের মতো যুক্তরাষ্ট্রে ডলার রিজার্ভ রাখে। তাই আফগানিস্তানের ঘটনার পর এ নিয়ে সবাই নতুন করে ভাবতে শুরু করবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো চীন, জাপান, ইউরোপ প্রভৃতি দেশেরও বড় আকারের রিজার্ভ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।  

 

৯/১১-এর শিকারদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানের অর্থ ব্যবহার করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের খোড়া যুক্তি মেনে নিলে একদিন মার্কিনীরা জার্মানি ও জাপানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহার করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শহীদদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেবে, তাও কি মেনে নিতে হবে?

 

যুক্তরাষ্ট্র নির্বিচারে আফগানিস্তানের সম্পত্তি আমেরিকানদের জন্য ব্যবহার করেছে, এবং তথাকথিত ট্রাস্ট ফান্ড প্রতিষ্ঠায় কোনো নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা এবং ব্যবহারের পদ্ধতি নির্দিষ্ট করেনি। কে গ্যারান্টি দিতে পারে, এই অর্থ আফগানিস্তানের মানবিক সংকট সমাধানে ব্যবহার করা হবে? নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ২০২০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন পুনর্গঠন সহায়তার মাত্র ১২ শতাংশ আফগান সরকারের কাছে গেছে এবং অবশিষ্ট অর্থের বেশিরভাগ লুইস বার্জার গ্রুপের মতো মার্কিন কোম্পানিগুলো মেরে দিয়েছে।

 

আফগানিস্তান এখন যে মানবিক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে, তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র দায়ী। নিরপরাধ আফগানদের দুর্যোগ ও দুর্ভোগের মুখে ছেড়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত দায়িত্বহীনভাবে আফগানিস্তান থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। ফলে আফগান জনগণ একটি গুরুতর মানবিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে, এবং আফগানিস্তান ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সম্মুখীন হচ্ছে। এই সংকটময় মুহূর্তে, যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র আফগান জনগণকে মানবিক সঙ্কট মোকাবিলায় বাধা দেয়নি, বরং তারা প্রকাশ্যে আফগান জাতীয় সম্পদ লুট করেছে এবং আফগান জনগণের দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছে, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সারমর্ম হল মার্কিন আধিপত্য ও ক্ষমতার নিয়ম ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা।  তবে অনেক স্বাধীন বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলছেন, ৯/১১ এর ঘটনায় যদি আফগান জনগণকে মূল্য দিতে হয়, তাহলে আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা ও ২০ বছর মেয়াদি যুদ্ধের জন্য কে ক্ষতিপূরণ দিবে? আফগানিস্তানসহ বিবেকবান বিশ্বের নিঃসন্দেহে এই প্রশ্নের জবাব পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

 

লেখক: লি ওয়ান লু শিশির