চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির টাইমিং কেন্দ্রের প্রধান বিজ্ঞানী চাং শৌ কাং এবং তাঁর ‘টাইমিং দল’
2022-03-07 16:56:04

গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে চীনের কয়েক প্রজন্মের ‘টাইমিং’ বিজ্ঞানীরা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দূরবর্তী এলাকায় চরম পরিশ্রম ও অবদানের মাধ্যমে চীনের জন্য সুনির্দিষ্ট ‘সময় ব্যবস্থা’ গড়ে তোলেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির টাইমিং কেন্দ্রের প্রধান বিজ্ঞানী চাং শৌ কাং এবং তাঁর ‘টাইমিং দলের’ গল্প তুলে ধরবো।

চীনের শাআনসি প্রদেশের রাজধানী সি’আন শহরে বিশ্ব বিখ্যাত ছিন রাজবংশ আমলের টেরাকোটা ওয়ারিয়র্স রয়েছে। আসলে এ প্রাচীন শহরে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির জাতীয় টাইমিং কেন্দ্রও নির্মিত হয়েছে। এ কেন্দ্র গঠনের আগে সেটি শাআনসির মানমন্দির ছিল। চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির ‘টাইমিং কেন্দ্রের’ পরিচালক ও প্রধান বিজ্ঞানী অধ্যাপক চাং শৌ কাং এবং তাঁর কর্মদল অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি আয়ত্ব করে চীনের সময়ের মানদন্ডের সাথে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের ব্যবধান ব্যাপকভাবে কমিয়ে এনেছেন। আগে যেখানে এ ব্যবধান ছিল ১০০ ন্যানোসেকেন্ড, এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে  ৫ ন্যানোসেকেন্ডে।

অধ্যাপক চাংয়ের অফিসের টেবিলে একটি সাদা রঙয়ের টি-শার্ট দেখা যায়। এর ওপর বালতি আকারের একটি স্পষ্ট যন্ত্রের নকশা আছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি বিশ্বের প্রথম সিসিয়াম পারমাণবিক ফোয়ারা ঘড়ির রূপান্তর-কাজে অংশ নেওয়ার জন্য এ সুভেনির টিশার্ট পেয়েছি।”

১৯৬৭ সালে সময় পরিমাপের ক্ষেত্রে নির্ভুলতা উন্নয়নে ১৩তম আন্তর্জাতিক পরিমাপ সম্মেলনে সময়ের পরিমাপের ইউনিট ‘সেকেন্ড’ যুক্ত হয়। তখন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পদার্থবিদরা সময় পরিমাপের সাথে খাপ খাওয়াতে পরমাণু ঘড়ির গবেষণা চালান। সেটি কেবল একটি দেশের সময় ফ্রিকোয়েন্সি উন্নতির প্রতীকই নয়, বরং সে দেশের দক্ষতার প্রতিফলন।

পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদার্থবিদ ওয়াং ই ছিউ বলেন, ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলাকালে পরমাণু ঘড়ির ভুমিকা পারমাণবিক বোমার সাথে তুলনা করা হয়। ১৯৯৮ সালে একজন পাশ্চাত্য পদার্থবিদ চীন পরিদর্শনের পর বলেন, চীনের পরমাণু ঘড়ির গবেষণা কেবল ‘ভাগ্য’-এর ওপর নির্ভর করে। এমন উস্কানিমূলক কথা শুনে অধ্যাপক চাং শৌ কাং চীনাদের জন্য নিজস্ব পরমাণু ঘড়ি গবেষণায় সিদ্ধান্ত নেন।

২০০৫ সালে তিনি বিদেশ থেকে লেখাপড়া শেষ করার পর বেইজিং থেকে সি’আনে চলে আসেন এবং তখন থেকেই পরমাণু ঘড়ি ও স্ট্যান্ডার্ড সময় নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। অধ্যাপক চাংয়ের সহপাঠী কুও ওয়েন ক্য প্রায় একই সময় বিদেশ থেকে চীনে ফিরে আসেন। তাদের সি’আন গবেষণা নিয়ে কুও বলেন, সেই সময় চীনের টাইমিং কেন্দ্রে ব্যবহৃত সিসিয়াম পারমাণবিক ঘড়ির সবই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। কোনো বেঞ্চমার্ক সিসিয়াম ফাউন্টেন ঘড়ি ছিল না, কোনো গবেষণা-সরঞ্জাম ও গবেষকও ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে অধ্যাপক চাং একাই সি’আনের একটি বেসমেন্ট অফিস থেকে গবেষণার কাজ শুরু করেন।

১৭ বছর পর তাঁর উদ্যোগে নির্মিত জাতীয় টাইমিং কেন্দ্রের কোয়ান্টাম ফ্রিকোয়েন্সি স্ট্যান্ডার্ড ল্যাবরেটরিতে যুব-গবেষকের সংখ্যা একশত ছাড়িয়েছে। তারা কেবল বিশ্বের উন্নত বেঞ্চমার্ক সিসিয়াম ফাউন্টেন ঘড়ি নিয়ে গবেষণা করেননি, বরং ২০১৮ সালে সহজে বহনযোগ্য সিসিয়াম ঘড়িও সফলভাবে তৈরি করতে সক্ষম হন।

আসলে এ ধরনের ঘড়ির প্রযুক্তি গত অর্ধেক শতাব্দী ধরে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের আয়ত্বে ছিল। ২০১৭ সাল থেকে চীনের কাছে এ ঘড়ির বিক্রিও বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আর বর্তমানে চীনের তৈরি সিসিয়াম ঘড়ি পেইতৌ নেভিগেশন ব্যবস্থা, ছাংহ্য-২ নেভিগেশন ব্যবস্থা, ৫জি টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন গবেষণায় ব্যবহার করা হয়। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে চীনের তৈরি ৩টি সিসিয়াম ঘড়ি আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড সময় হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে এবং ব্যাপক স্বীকৃতি পায়। ফলে তা আন্তর্জাতিক পরিমাপ ব্যুরোর সুপারিশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্ট্যান্ডার্ড সময় হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

২০১৯ সালে একটি সেমিনারে বহু বছর আগে ‘চীন নিজস্ব  টাইমিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে না’ বলে মন্তব্যকারী অধ্যাপকের সঙ্গে চাংয়ের দেখা হয়। তখন ওই অধ্যাপক চীনের পরমাণু ঘড়ির প্রশংসা করেন।

অধ্যাপক চাংয়ের গবেষকদল কম সময়ের মধ্যে অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। তবে যারা টাইমিং নিয়ে গবেষণা করেন, তারা নির্ভুলতা বাড়ানোর জন্য অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তাই প্রতিটি গবেষণা-সাফল্য তাদের জন্য নতুন গবেষণার আরম্ভের মতো।

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর দেশের প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক খাতের চাহিদা মেটাতে নিজস্ব টাইমিং কেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি হয়ে যায়। ১৯৬৬ সাল থেকে তত্কালীন চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের নির্দেশনায় শাআনসি প্রদেশের পুছেং জেলায় মানমন্দির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৭১ সাল থেকে শর্টওয়েভ টাইমিং শুরু হয়।

শাআনসি মানমন্দির নির্মাণকাজে বেইজিং, শাংহাই ও নানচিংসহ বিভিন্ন বড় শহরের বিজ্ঞানী ও স্নাতক শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। এ সম্পর্কে শাআনসি মানমন্দিরের সাবেক মহাপরিচালক ছি কুয়ান রুং বলেন, সেই সময় তিনি মাত্রই নানচিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন এবং প্রথম দলের কর্মী হিসেবে তিনি সহপাঠীদের সাথে ট্রেন ও বাসে অনেক দূরের পথ অতিক্রমের পর দূরবর্তী পুছেং জেলায় পৌঁছান। সেই সময় মানমন্দির নির্মাণের স্থানে কিছুই ছিল না। ছি বলেন, “তখন আমরা ভাবিনি যে পাথর বহন করে আমাদেরকে মানমন্দির নির্মাণ করতে হবে।” সবার প্রচেষ্টায় ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে পরীক্ষামূলকভাবে লং ওয়েভ টাইমিং স্টেশন চালু হয় এবং প্রায় ৪ মাস পর সেটি প্রতিদিনের নির্দিষ্ট সময়সেবা দিতে থাকে।

চীনের সুবিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিয়ান স্যুয়ে সেন বলেন, “সারাদেশে একই মানদন্ডের টাইমিং ঘড়ি ব্যবহার করা কেবল উন্নত প্রযুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং চীনের বিজ্ঞান মহলের উন্নয়নের জন্যও অতি গুরুত্বপূর্ণ।”

লংওয়েভ টাইমিং ব্যবস্থা গড়ার পাশাপাশি চীন এ খাতে উন্নয়নের গতিও ধরে রেখেছে। স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে চীনের টাইমিং ব্যবস্থার গবেষণায় অনেক যুব-বিজ্ঞানী পশ্চিম চীনের দূরবর্তী এলাকায় নিজেদের সেরা সময় উত্সর্গ করেন। ১৯৮০ সালে শাআনসি মানমন্দির লিনথুং শহরে স্থানান্তর করা হয় এবং ২০০১ সালে এর নাম চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির জাতীয় টাইমিং কেন্দ্র রাখা হয়।

পরমাণু ঘড়ি উন্নত তত্ত্ব এবং শীর্ষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে অর্জিত হয়। তাই ১০ বছর বা আরও বেশি সময় নিয়ে এ ক্ষেত্রে গবেষণা-কাজ চালানো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। টাইমিং গবেষকদের কষ্ট কেবল শারীরিক নয়, বরং মানসিকও বটে। দিন-রাত হাজার হাজার যন্ত্রপাতি পর্যবেক্ষণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাদেরকে একাকীত্বও সহ্য করতে হয়।

চীনের জাতীয় টাইমিং কেন্দ্রের গবেষক ছাং হং স্ট্রন্টিয়াম পারমাণবিক ঘড়ি নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। পরিবারের একমাত্র সন্তান তিনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার সময় তার পিতামাতা মারা যান। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “যখন রাতে ফোন আসলো, তখন অনেক ভয় পেলাম। কারণ, বুঝতাম অবশ্যই পরিবারে কোনো জরুরি ব্যাপার ঘটেছে।”

গবেষণার কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি বাসায় ফিরতে পারেননি।  গবেষণা-কাজ তখন সন্ধিক্ষণে ছিল। তা ছাড়া, এটা গোটা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি মনের দুঃখ মনে চেপে গবেষণা-কাজ চালিয়ে গেলেন।

পরমাণু ঘড়ি নির্মাণ সারা জীবনের কার্যক্রম। এটি কেবল দেশের চাহিদা নয়, বরং বিভিন্ন শিল্প ও পেশার উন্নয়নে পরমাণু ঘড়ির প্রয়োগ আছে। এ সম্পর্কে অধ্যাপক চাং শৌ কাং বলেন, গত ৩১ বছরের মধ্যে তিনি গবেষকদল নিয়ে ৯ ধরনের নতুন পরমাণু ঘড়ি তৈরি করেছেন। সমাজের উন্নয়ন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে টাইমিংব্যবস্থা শুধু গণজীবিকার সাথে জড়িত ব্যাপার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

২০০৩ সালে দেশের জরুরি চাহিদা মেটাতে জাতীয় টাইমিং কেন্দ্র এবং সংশ্লিষ্ট গবেষণাগার সময় ফ্রিকোয়েন্সি ও জ্যোতির্বিদ্যা বিজ্ঞান তত্ত্বের মিশেলে ৩ বছরের মধ্যে চীনের জিপিএস ব্যবস্থাপনা ‘সিএপিএস’ স্থাপন করা হয়। এর নির্ভুলতা মার্কিন জিপিএস ব্যবস্থাপনার প্রায় সমান।

সিএপিএস ব্যবস্থাপনার গবেষণা থেকে চীনা বিজ্ঞানীদের নব্যতাপ্রবর্তনের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। নব্যতাপ্রবর্তন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। ২০১২ সালের পর চীনের জাতীয় টাইমিং কেন্দ্র অব্যাহতভাবে সৃজনশীলতায় সাথে নব্যতাপ্রবর্তনের পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের চলমান গবেষণার বিষয় মাইক্রোওয়েভ পারমাণবিক ঘড়ির চেয়ে নির্ভুলতা আরো উন্নত হাল্কা ঘড়ি মহাশূন্য পাঠানো, যাতে উচ্চ নির্ভুলতার সময় মানদন্ড বাস্তবায়ন করা যায়।

অধ্যাপক চাং এবং তাঁর গবেষকদল গত ১০ বছর ধরে হাল্কা ঘড়ি তৈরি করেছেন। বর্তমানে তাদের মূল কাজ বড় সাইজের এ হাল্কা ঘড়ি এক বর্গমিটারের চেয়ে ছোট মহাশূন্য স্টেশনের পরীক্ষাগারে রাখা। শুধু আকার নয়, বরং এ ধরনের গড়ি নির্মাণ-পদ্ধতি ও কৌশলও জটিল। তাদেরকে এ জন্য ধারাবাহিক প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

এ সম্পর্কে অধ্যাপক চাং বলেন, “জাতীয় টাইমিং কেন্দ্রের সময় ফ্রিকোয়েন্সি ও টাইমিং কাজের বড় অগ্রগতির সাথে আমাদের পরিশ্রমী সহকর্মীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাদের প্রচেষ্টা ও দায়িত্বশীল মনোভাবের কারণে আমরা অনেক অসম্ভব সম্ভব করেছি। রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষায় আমরা নিরলস প্রচেষ্টা চালাবো।”

টাইমিং ব্যবস্থাপনা পূর্ণাঙ্গ হলে চীনের মহাকাশ-গবেষণায় আরও বেশি সাফল্য অর্জিত হবে। এ খাতে আরো বেশি সাফল্য অর্জিত হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)