পরিচালক চাং ই মৌ
2022-03-05 14:59:56

আশা করি, চাং ই মৌ-এর নাম ইতোমধ্যে আপনারা শুনেছেন। তিনি বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। এ দুটি অনুষ্ঠান চীনসহ বিশ্ববাসীর মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। লাল লন্ঠন, গ্র্যান্ড আতশবাজি, চীনা গিঁট এবং স্নোফ্লিক্সসহ চীনের বৈশিষ্ট্যময় নানা উপাদান এবং টর্চ জ্বালানোর পদ্ধতিসহ নানা সৃজনশীল বিষয় সত্যিই আকর্ষণীয় ও বিস্ময়কর ছিল। আগামীকাল শীতকালীন প্যারালিম্পিক গেমস উদ্বোধন করা হবে। চাং ই মৌ প্যারালিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের পরিচালক। ৭১ বছর বয়সী চাং এবারের শীতকালীন অলিম্পিক গেমসকে সামনে রেখে অনেক পরিশ্রম করেছেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চাং ই মৌ’র গল্প বলবো।

 

চীনা ভাষার পরিচালকের কথা বলতে গেলে, আমরা সাধারণত বলি, কে কে প্রতিভাবান। তবে প্রতিভাবান লোকদের তালিকায় চাং ই মৌ’র নাম নেই।

তিনি কখনই জিনিয়াস ছিলেন না। অনেকদিন ধরেই তিনি ছিলেন পেছনের সারির পরিচালক। তিনি যখন যুবক ছিলেন, তখন তিনি তার পরিবার নিয়ে খারাপ অবস্থায় দিন কাটাতেন।

তার বিশেষ পারিবারিক পটভূমির কারণে ছোটবেলা থেকে চাংয়ের সঙ্গে বাজে আচরণ করা হতো এবং অন্যরা তাকে তুচ্ছ ভাবে দেখতো।

চীনের সেই বিশেষ সময় পারিবারিক প্রেক্ষাপটের কারণে তার খুব বেশি আশা ছিল না।

তিনি সাত বছর শিয়েনইয়াং ‘শহরের অষ্টম কটন মিলে’ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি সেই সময় ফটোগ্রাফির কাজ করেন। তিনি নিজেকে পুরোপুরিভাবে এই শখের দিকে নিয়োজিত করেন। যখনই তিনি ফ্রি হন, তখনই তিনি পাগলের মতো লেখাপড়া করেন এবং ডজনখানেক নোট তৈরি করেন।

 

একটি ক্যামেরা কেনার জন্য তিনি শরীরের রক্ত বিক্রি করেন এবং অবশেষে একটি ক্যামেরা কিনতে সক্ষম হন।

তাঁর তোলা ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি এই শিল্পে জড়িত হওয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।

তারপর সারা চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। তখন ২৮ বছর বয়সী চাং বেইজিং ফিল্ম একাডেমিতে আবেদন করতে পারেন নি। তার চমৎকার ফটোগ্রাফির কারণেই চাং ব্যতিক্রম শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন। তবে দুটি শর্ত ছিল। তা হলো: তাকে দু’বছর সময় দেওয়া হয় এবং দু’বছর পর তার ফলাফল ভালো না হলে বেইজিং ফিল্ম একাডেমি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর চাং কিছুটা অতৃপ্ত ছিলেন।

একদিকে বয়সের কারণে, সহপাঠীদের চেয়ে তিনি অনেক বয়স্ক ছিলেন। তার একই ক্লাসে লেখাপড়া সহপাঠীরা চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক-সংক্রান্ত লোকদের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন।

সব দিকের ঘাটতি পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হন তিনি। দামী একটি ফটোগ্রাফি বই কিনতে না পারায় তিনি হাত দিয়ে দুই লাখ শব্দ কপি করেন।

বাসায় কোনো সরঞ্জাম না থাকায় তিনি কাঁচা লোহা দিয়ে ক্যামেরা তৈরি করেন।

সময় থাকলে তিনি নিজের তৈরি সেই ক্যামেরা কাঁধে রেখে হাতের শক্তি দিয়ে ক্যামেরার মুভমেন্ট অনুশীলন করেন।

সেই সময় চাং সবসময় একটি ভয়ে ছিলেন। তাঁর মনে হতো যে কোনো সময় তাকে বের করে দেওয়া হতে পারে।

সফলভাবে স্নাতক পাস করায় তার হৃদয়ের বোঝা কিছুটা হালকা হয়।

স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর, চাং একজন ফটোগ্রাফার হিসাবে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন।

 

‘One and Eight’ নামে একটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র বাজারের মানুষদের কাছে পরিচিতি পান। সেই সময় সি’আন ফিল্ম স্টুডিওর তত্কালীন পরিচালক উ থিয়েনমিং এই যুবককে লক্ষ্য করে বলেন এবং তাকে ছেন খাইক্য’র সঙ্গে ‘দ্য ইয়েলো আর্থ’ চলচ্চিত্র শুটিং করতে হবে।

এ চলচ্চিত্র শুটিং করা হয় গরম জুন মাসে। চাং ও ছেন প্রতিদিন ভোর চারটায় উঠে প্রতিটি শটের ডিজাইন এবং বিন্যাস নিয়ে আলোচনা করতেন।

স্বাভাবিকভাবেই, চাংয়ের ফটোগ্রাফিক প্রতিভা ছিল অসামান্য। কিন্তু পরিচালক হিসেবে তার প্রতিভা দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কিত। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, যখন আমরা অন্যান্য বিখ্যাত চীনা পরিচালকের কথা উল্লেখ করি, তখন প্রায়ই প্রত্যেকের একটি স্বতন্ত্র শৈলীর কথা মনে পড়ে।

কিন্তু চাং ই মৌ’র চলচ্চিত্রের কথা বলতে গেলে, বিশাল দৃশ্য-বিন্যাস এবং শক্তিশালী রংয়ের কথা মনে পড়ে।

ফটোগ্রাফি ছাড়া চলচ্চিত্র শুটিংয়ের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া কঠিন।

অর্থাৎ এই স্টাইল- যা পরিবর্তনযোগ্য। তবে এটি মূল্যায়নের অর্থ হলো পরিচালক চাং তার নিজস্ব সিস্টেম তৈরি করেন নি।

তবে চাং হচ্ছেন চীনের সবচে পরিশ্রমী পরিচালক। ১৯৮৮ সালে তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘Red Sorghum’ থেকে এখন পর্যন্ত তিনি প্রায়ই বছরে একটি চলচ্চিত্র তৈরির প্রক্রিয়ায় মোট ২৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে আরো আছে দুটি অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান পরিচালনা, অসংখ্য অপেরা অনুষ্ঠান, গালা অনুষ্ঠান এবং প্রচারণামূলক ভিডিও প্রভৃতি।

 

তিনি আগে এভাবে নিজের মূল্যায়ন করেছিলেন যে, আমি বলতে পারি না যে, আমি চীনের সেরা পরিচালক। তবে আমি বলতে পারি যে, আমি চীনের সবচেয়ে পরিশ্রমী পরিচালক।

যারা পরিচালক চাংয়ের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাদের সবার মূল্যায়ন একরকম, তা হলো তিনি ‘কাজ পাগল মানুষ’।

তিনি টানা দশ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কাজ করতে পারেন, নানা সম্মেলন, নানা যোগাযোগ করতে পারেন।

তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ঘড়ির কাঁটা আধা ঘন্টা এগিয়ে রাখেন এবং এভাবেই নিজেকে সময় নষ্ট না করার দিকে মনোযোগ দেন।

 

গত কয়েক দশকে চাং ইমৌ’র অর্জনগুলো ছিল অসাধারণ। এখন তার কথা উল্লেখ করলে প্রায়ই প্রশংসার কথা শোনা যায়। তবে আগে তাকে নিয়ে অনেক সমালোচনাও ছিলো। গালাগালি করা ও অভিযোগ করা তাঁর পুরো ক্যারিয়ারের সঙ্গে জড়িত।

 

আগে তিনি অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছেন। ভেনিস চলচ্চিত্র উত্সব, বার্লিন চলচ্চিত্র উত্সব ও কান চলচ্চিত্র উত্সবের নানা পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছেন তিনি। তা ছাড়া, তিনি তিনবার অস্কারের শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার মনোনোয়ন পেয়েছেন এবং আর অন্যান্য পুরস্কার জিতেছেন।

তবে, আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত চাং চীনে অনেক সমালোচিত ছিলেন। কেউ কেউ বলে থাকেন যে, তার চলচ্চিত্রগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে চীনকে কলঙ্কিত করেছে ও অপমান করেছে এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের স্বাদ পূরণ করেছে।

‘হিরো’ নামে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনের পর অনেকেই সরাসরি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, চাং ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন এবং আর কোনো ভালো শিল্পকর্ম তৈরি করতে পারছেন না।

 

‘হিরো’ চলচ্চিত্রটি হলিউডে কোনো চীনা পরিচালকের উদ্যোগে বাণিজ্যিক ফিল্ম শুটিংয়ের নতুন যুগের সূচনা করে। চলচ্চিত্রের বক্স অফিসে পারফর্মেন্স ভালো হলেও দর্শকদের মন্তব্য তেমন সন্তোষজনক নয়। কিছু দর্শক তার শৈল্পিক সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হারানো এবং খারাপ চলচ্চিত্র তৈরি করার জন্য তার সমালোচনা করেন। ‘এটির শুধু লাইনআপ আছে, রঙগুলি চমত্কার তবে অন্তঃসারশূন্য এবং গল্পটি হালকা ও যথেষ্ট আকর্ষণীয় নয়।’

এমন কথা বলেন কেউ কেউ।

বাইরের এসব কথার জবাবে চাং ই মৌ বরাবরই চুপ থাকেন। চলচ্চিত্রের বিষয় ছাড়া, তিনি কখনও অন্যদের সঙ্গে ঝগড়া ও কথা বলার ওপর গুরুত্ব দেন না।

চলতি বছর চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে চাং ই মৌ’র নামের পাশে ‘ইতিহাসের প্রথম দুটি অলিম্পিক অনুষ্ঠানের পরিচালক’ এই খেতাব যোগ হয়েছে।

অনেক মর্যাদা পেলেও তিনি পরিশ্রমী চরিত্র পরিবর্তন করেন নি। চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে শুরু করে অলিম্পিক গেমস পর্যন্ত, তিনি আগের মতোই ‘কাজ পাগল মানুষ’।

 

‘Lifetimes Living’ নামে চলচ্চিত্র শুটিং করার সময় তিনি মুভি শুটিং করার পাশাপাশি পাণ্ডুলিপিও সংশোধন করেন। মাঝে মাঝে প্রধান অভিনেতা তার কথা শুনতে শুনতে শুয়ে পড়তো।

অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিমূলক কাজ করার সময় চাং আরো কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছেন।

‘চাং ই মৌ-র ২০০৮’ শিরোনামে এক তথ্যচিত্রে তিনি এমন একটি কথা বলেছিলেন যে, ‘পরিচালক হিসেবে সারা জীবনে আমি অনেক চলচ্চিত্র শুটিং করতে পারি, তবে সারা জীবনে অলিম্পিক অনুষ্ঠান পরিচালনার সুযোগ হয়তো মাত্র একবার।’

তিনি বলেন, চলচ্চিত্রের চেয়ে অলিম্পিক একটু ভিন্ন রকম এবং ১৪০ কোটি চীনা মানুষের চাহিদা পূরণ করা উচিত্।

 

দুই বছরব্যাপী প্রস্তুতির সময়ে তিনি ও তার দল হাজার বার বড় ও ছোট সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন।

২০০৮ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে একটি উদাহরণ হিসেবে নিয়ে বলা যায়, সর্বপ্রথমে অনেকে ড্রামা ব্যবহার করার প্রস্তাব করেন। তবে, তিনি রাজি ছিলেন না। তিনি মনে করেন, ড্রামা ব্যবহার করার মধ্যে আসলে নতুন কিছু নেই। ২০০৮ সালের অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কাগজ নিয়ে সৃজনশীল প্রস্তাবের দৃঢ় বিরোধিতা করেন অনেকে। কারণ, প্রযুক্তি ও খরচসহ অনেক বিষয়ে বিবেচনা করায় তা বাস্তবায়ন করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। তবে চাং ই মৌ কাগজ ব্যবহারের বিষয়ে জিদ ধরে থাকেন। তার এই চেষ্টার কারণে চীন বিশ্বকে সেই আশ্চর্যজনক ছবি দেখাতে পেরেছিল।

 

২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিক গেমস চলাকালে চাং ই মৌ একই রকম মানসিকতা বজায় রাখেন। তবে ২০০৮ সালের চেয়ে একটু ভিন্ন বিষয় হলো তার মুখে এবার আমরা ক্লান্তি দেখতে পেয়েছি। তিনি এখন ৭১ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধ এখন।

যারা চাং ই মৌ’র সঙ্গে সহযোগিতা করেন, তারা এ তিনটি শব্দ দিয়ে তাকে বর্ণনা করেন, এ তিনটি শব্দ হলো; আরও তীক্ষ্ণ, আরও দায়িত্বশীল, আরও কঠোর পরিশ্রম।

 

শীতকালীন অলিম্পিক গেমস সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়েছে। অনেকে বলেন, এবার চাং ভালোভাবে বিশ্রাম নিতে পারবেন। আসলে তা নয়, আগামীকাল প্যারালিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হবে। এবারের পরিচালকও তিনি। তিনি বিশ্রাম নিতে পারেন না এবং তিনি বিশ্রাম নিতে চান না। যতক্ষণ পর্যন্ত তার শক্তি আছে, তিনি অবশ্যই কঠোর পরিশ্রম করবেন।

 

তার সবচেয়ে প্রিয় চলচ্চিত্র মানুষ, অর্থাত্ জাপানের বিখ্যাত পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজক আকিরা কুরোসাওয়া এমন একটি কথা বলেছিলেন যে, আমার জীবন বিয়োগ সিনেমা, সম্ভবত শূন্য হয়ে যাবে। এই বাক্যটি চাং ই মৌ’র ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদিও নিষ্ঠুর শোনাচ্ছে, তারপরও সম্ভবত এই জীবনের জন্য তিনি আকাঙ্ক্ষিত। তার কাছে চলচ্চিত্রের জন্য কষ্টও এক ধরনের সুখ ও আনন্দ।