‘সোনা দিয়ে তৈরি কাঁধে নেওয়া ঝুড়ির’ গল্প
2022-03-02 16:27:48

ছোট একটি আপেল; তবে, চীনের শায়ানসি প্রদেশের গ্রামকে ধনী করা ‘বড় সোনালি ফল’ হতে পারে। এতে কৃষির আধুনিকায়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাহলে চীনের কৃষির আধুনিকায়ন কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে? এতে কি কি শিক্ষণীয় বিষয় আছে? আজ আপনাদের জানাবো চীনের এমন কয়েকটি গ্রামের গল্প।

চীনের শায়ানসি প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে সারা বছর খরা লেগেই থাকে, বৃষ্টি খুবই কম। জমি খুব অনুর্বর। গত শতাব্দীর ৬০, ৭০ দশকে শায়ানসি প্রদেশের ইয়ান ছুয়ান জেলার লিয়াং চিয়া হ্য গ্রামের লোকজনের স্বপ্ন শুধুই ‘অর্ধেক বছর তুষ এবং বাকি অর্ধেক বছর শস্য খায়’। এখন অনেক বছর পার হয়েছে। লিয়াং চিয়া হ্য গ্রামে আকাশ পাতাল পরিবর্তন ঘটেছে। গ্রামবাসীদের মাংস খাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কৃষির আধুনিকায়নের মাধ্যমে স্থানীয় আপেল শিল্পের বিরাট উন্নতি ঘটেছে।

চাং ওয়েই ভাং লিয়াং চিয়া হ্য গ্রামের একজন অধিবাসী। তিনি বলেন, বর্তমানে জীবন অনেক ভালো। যখন মাংস খেতে চাই, তখন খেতে পারি। তবে এখন সবার কাছে মাংস মূল্যবান খাবার নয়। সবাই সবজি ও ফল খায়। আমাদের স্থানীয় আপেল বেশ সুস্বাদু। সবাই আমাদের এখানকার আপেল খেতে পছন্দ করে।

বিশ্বে প্রতি সাতটি আপেলের মধ্যে একটি চীনের শায়ানসি প্রদেশের। প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে সূর্য দীর্ঘ সময় থাকে, জমির মান ভালো। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্যও অনেক বেশি, বিশেষভাবে আপেলের পুষ্টি ও মিষ্টির মান বৃদ্ধির জন্য তা উপযোগী। তবে আগে ঐতিহ্যবাহী আপেল চাষের পদ্ধতিতে আপেল উত্পাদনের মান অনেক কম ছিল।

চাং ওয়েই ভাং জানান: জমি উর্বর করার সময় তা করা হয় নি; ওষুধ দেওয়ার সময় ওষুধ ছিটানো হয় নি। এ কারণে আপেল উত্পাদনের মান বেড়েছে।

আপেল শিল্প জোরদার করার জন্য ২০১৪ সালে স্থানীয় আপেল বাগানে শিলাবৃষ্টি প্রতিরোধের জন্য নেট লাগানো হয়। বিশেষজ্ঞ কৃষকরা আপেল চাষের পদ্ধতি শিখিয়েছেন। কৃষক চাং ওয়েই ভাং জানান, বিজ্ঞানসম্মত পরিচালনা পদ্ধতি শিখেছি, জমি উর্বর করার পদ্ধতি শিখেছি, তারপর শিলাবৃষ্টি প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সব ব্যবস্থা নেওয়ার পর আপেল উত্পাদনের মান অনেক বেড়েছে, স্বাদও আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।

কৃষির আধুনিকায়ন শস্য ও ফলের চাষ ছাড়া, ফসল, প্যাকেজ ও বিক্রি করা যায়। শায়ানসি প্রদেশের একটি ফল কোম্পানির প্রধান চাং হেং লিয়াং জানান, তার কোম্পানিতে ফল বাছাই করার বিশেষ মেশিন আছে। এর মাধ্যমে আপেলের আকার, রং এবং আপেল ভালো কি না- তা বাছাই করা যায়, এই মেশিন আপেল কত মিষ্টি এবং ভিতরে কোনো পোকা আছে কিনা তা যাচাই করতে পারে। ভোক্তারা আপেলের কিউআর কোড স্ক্যান করে বুঝতে পারেন যে কেমন আপেল তারা কিনেছে।

২০২০ সালে চীনের বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্মেলন চীনের জাতীয় গণকংগ্রেস এবং গণরাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের বার্ষিক সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং অতীতের কঠোর জীবনের কথা স্মরণ করে বলেন, তিনি আগে ছয়/ সাত বছর কৃষক ছিলেন। তখন তিনি খালি পেটে কাছের লোকদেরকে জিজ্ঞেস করতেন, তোমাদের দৃষ্টিতে কেমন জীবন ভালো জীবন? জীবনের বিস্তারিত লক্ষ্য কি? তাদের উত্তর ছিল, প্রথম লক্ষ্য হল ভিক্ষা না করা, পেট ভরে খেতে পারা। দ্বিতীয় লক্ষ্য হল ভুট্টার মত শস্য খেতে পারে। তৃতীয় লক্ষ্যটি তখন অসম্ভব স্বপ্ন ছিল। তা হল যেটা খেতে চায়, সেটাই খাওয়ার সুযোগ পাওয়া। যখন মাংস খেতে মন চায়, তখন মাংস খাওয়া। প্রেসিডেন্ট সি তখন সবাইকে বলেন, তোমরা সাহসের সঙ্গে চিন্তা করো, আরও কি কি চাও। জনসাধারণ উত্তরে জানিয়েছিল, ভবিষ্যতে পাহাড়ে কৃষিকাজ করতে ‘সোনা দিয়ে তৈরি কাঁধে নেওয়া ঝুড়ি’ নিতে পারবো। প্রেসিডেন্ট সি বলেন, এমন লক্ষ্য আসলে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ‘সোনা দিয়ে তৈরি কাঁধে নেওয়া ঝুড়ি’- তাঁর অর্থ কৃষির আধুনিকায়ন।

অতীতে শস্য চাষ করা খুব কঠিন কাজ ছিল। সারা বছর পরিশ্রম করেও ভালো ফসল পাওয়া যেত না। তবে, এখন বিজ্ঞানের সাহায্যে কৃষিকাজ আধুনিক হয়েছে। এমন জমিতে কৃষিকাজ আরও সহজ হচ্ছে।

ছিউ সৌ সিয়ান চীনের হ্যনান প্রদেশের শাং সুই জেলার চাং চুয়াং গ্রামের কৃষক। তিনি বলেন, এখন বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে শস্য চাষ করা হয়। একটি মোবাইলফোন অ্যাপের মাধ্যমে আমার ১৩৩ হেক্টর জমি পরিচালনা করতে পারি। কোন জমিতে পানির অভাব হলে, আমি সেই জমিতে পানি দিই।

এমন এপিপি দিয়ে দূরের জমিতে পানি ঢালা, উর্বর করা, পোকা ও রোগ-বালাই ঠেকানোর কাজ করতে পারি। বুদ্ধিমান নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এসব আধুনিক কৃষি যন্ত্র পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ করতে পারে। এতে জমির পরিচালনা, তত্ত্বাবধান, তথ্যের প্রকাশসহ বিভিন্ন কৃষি সেবা দেওয়া যায়। বড় আকারের মেশিন দিয়ে ফসল চাষে সাহায্য করা যায়। এভাবে কৃষির আধুনিকায়নের সেই ‘সোনা দিয়ে তৈরি কাঁধে নেওয়া ঝুড়ি’ নিশ্চিত হয়েছে।

চীনের সবজির গ্রাম সৌ কুয়াংয়ে, কৃষকরা ‘বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন গ্রিনহাউসের’ মাধ্যমে ঘরে বসে সবজি চাষ করতে পারে।  আধুনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা সূর্যের আলো বিভিন্ন উপাত্ত তত্ত্বাবধান করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্লেষণের পর পানি ঢালা এবং উর্বর করার চাহিদা থাকলে কৃষককে জানাতে পারে। এভাবে কীটনাশক ওষুধের অতি-ব্যবহার এড়ানো যায়, জমির গুণগতমান বাড়ানো যায়।

২০২০ সালের মে মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছিলেন, আসলে আমাদের এই প্রজন্মের একটি বিশেষ অনুভূতি আছে। তা হলো নিশ্চয় আমাদের জনসাধারণকে, বিশেষ করে আমাদের কৃষককে সাহায্য করতে হবে। সমাজতন্ত্রের পথে একজনও বাকি থাকতে পারবে না। যৌথভাবে সবাইকে ধনী হতে হবে।

আমরা চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর পড়া ‘সোনা দিয়ে তৈরি কাঁধে নেওয়া ঝুড়ির’ গল্প থেকে অনুভব করতে পারি, কৃষির উন্নয়নে বিজ্ঞান কত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে আরও বেশি নতুন প্রযুক্তি, নতুন কাঠামো এবং নতুন চিন্তাধারা জমিতে প্রয়োগ করা হবে। বিজ্ঞানের পাখায় ভর করে কৃষিকাজের উন্নয়ন আরও দূরে এগিয়ে যাবে।