দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ায় আগের দরিদ্র গ্রামের ছেলেরা এখন বিয়ে করতে পেরেছে
2022-02-25 15:56:11

চীনের পাহাড়ি এলাকায় অনেক গ্রাম আছে। দরিদ্রতার কারণে গ্রামে অনেক তরুণ ছেলে বিয়ে করতে পারে না। কোনো মেয়ে চরম দরিদ্র গ্রামে যেতে চায় না। তাহলে দারিদ্র্যমুক্তির পর এসব ছেলের জীবনে কেমন প্রভাব পড়েছে? তারা কি এখন বিয়ে করতে পেরেছে? আজ আপনাদেরকে এমন একটি গ্রামের কথা জানাবো।

 

চীনের হু নান প্রদেশের সি বা তুং গ্রামে, উ লিং পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত। অতীতে ভীষণ দরিদ্রতা ও অনুন্নত অবস্থার কারণে গ্রামের অনেক তরুণ ছেলে অবিবাহিত থেকে যেত। জীবনে কোনও আশার আলো ছিল না।  

অতীতের সি বা তুং গ্রাম চরম দরিদ্র অবস্থায় ছিল। লোকজনের আবাদি জমি খুবই কম ছিল। পুরো বছর অনেক কঠোর পরিশ্রম করে ধান চাষ করলেও শুধু নিজে খেতে পারতো। গ্রামবাসীরা জীবনযাপনের জন্য বাধ্য হয়ে বাইরে চাকরি করতো।

 

গ্রামবাসী লুং সিয়ান লান তাদের মধ্যে একজন। তিনি সাংবাদিককে বলেন, অতীতে গ্রামের মানুষজন মুরগি ও হাঁস ঘরের ভিতরে রাখত, মানুষের সঙ্গে তারা থাকত। কোনো মেয়ে আমাদের গ্রামে আসতে চাইতো না। বিশেষ করে আমাকে কেউ বিয়ে করতে চাইতো না। আমি শুধু বাইরে গিয়ে কাজ করতে চাইতাম।

 

২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সি বা তুং গ্রামে গিয়ে পরিদর্শন করেন। তিনি তখন ‘সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে দারিদ্র্যবিমোচনের’ গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাভাবনা উত্থাপন করেছেন। তিনি সবাইকে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার জন্য চেষ্টা করার উত্সাহও দেন। তিনি বলেন, যখন দারিদ্রের মূল কেটে দেওয়া হয়, তখন জীবন আরও ভালো হয়ে ওঠে। তখন স্ত্রীও পাওয়া যাবে।

 

২০১৪ সালের শুরুতে স্থানীয় জেলা সি বা তুং গ্রামে দারিদ্র্যবিমোচন কর্মদল পাঠিয়েছে। দলটি গ্রামের কর্মকর্তা এবং জনসাধারণের সঙ্গে ‘সুনির্দিষ্ট নীতির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনের’ ভালো উপায় খুঁজে নেয়। প্রত্যেক গ্রামীণ পরিবারে সুনির্দিষ্ট দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচি নেওয়া হয়। প্রত্যেক পরিবারের দারিদ্র্যবিমোচনের অবস্থা অনুযায়ী ভিন্নভাবে সাহায্য করে থাকে।

 

লুং সিয়ান লান এর আগে বাইরে কাজ করতেন। এই সুখবর শুনে তিনি গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং গ্রামে ফিরে দারিদ্র্যবিমোচন দলের কাছে যান।

লুং সিউ লিন হলেন সি বা তুং গ্রামের দারিদ্র্যবিমোচন দলের প্রথম মেয়াদের প্রধান। তিনি বলেন, গ্রামবাসী লুং সিন লান আমাদের কাছে এসে জানান যে, তিনি নিজেই কিছু করতে চান। কারণ দারিদ্র্যবিমোচন দল প্রত্যেক পরিবারের অবস্থা অনুযায়ী ভিন্ন দারিদ্র্যবিমোচনের প্রস্তাব প্রণয়ন করে। আমরা তাঁর অবস্থা অনুযায়ী তাকে প্রস্তাব দিয়েছি যে, প্রথমে স্থানীয় কৃষি স্কুলে গিয়ে কিছু কাজ শিখুন।

 

এভাবে লুং সিয়ান লান লেখাপড়া এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন যে, সি বা তুং গ্রামে ফুলের ধরণ বেশি, এবং বেশি সময় ফুল ফুটে থাকে। এমন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, লুং সিয়ান লান মধু চাষের চেষ্টা শুরু করেছেন। প্রথম বছরই ৫ হাজারেরও বেশি ইউয়ান আয় করেন তিনি। মধু চাষের কৌশল এবং আয় বাড়ানোর মাধ্যমে লুং সিয়ান লান বিয়ে করার সাহস পান।

 

লুং সিয়ান লান বলেন, ২০১৫ সালে গ্রামের অবিবাহিত ছেলেদের জন্য একটি বড় সভার আয়োজন করা হয়। এতে কাছাকাছি গ্রামের অবিবাহিত ছেলেমেয়েরা একসাথে পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। এই সভায় আমি সবাইকে বলেছিলাম, আমার অনেক কিছু নেই, শুধু আছে অনেক শক্তি। যদি কোনো মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে চায়, আমার হাত ধরতে চায়, আমি তাকে সারা জীবন সুখে রাখার প্রতিশ্রুতি দেবো।

 

উ মান জিন হলেন লুং সিয়ান লানের স্ত্রী। তিনি তখনকার কথা স্মরণ করে বলেন, সেই সভায় লুং সিয়ান লান সবার সামনে দশটি বুকডন (push-up) দেন। তা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলে। লুং সিয়ান লানের আন্তরিকতা মেয়ে উ মান জিনকে মুগ্ধ করে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে তারা দু’জন বিয়ে করেন। বিয়ে করার পর দু’জন মধু চাষের এক কমিউনিটি স্থাপন করেন। তাঁরা শুধু নিজেই এই কাজ করেন নি। বরং কাছাকাছি গ্রামের অন্যান্য অধিবাসীদের নিয়ে ধনী হওয়ার পথে এগিয়ে যান।

 

সি বা তুং গ্রামে দারিদ্র্যমুক্ত ও অবিবাহিত ছেলে শুধু লুং সিয়ান লান একাই ছিলেন না।

২০১৯ সালে গ্রামবাসী লুং হাই তুংও নিজের প্রিয় মানুষকে খুঁজে পান। সেই মেয়েটি হলেন কাছাকাছি গ্রামের সি মেই ফাং।

মেয়ে সি মেই ফাং তখনকার কথা স্মরণ করে বলেন, তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কোন গ্রামের মানুষ? সে বলেছিল, সি বা তুং গ্রামে। আমি বলেছিলাম, তোমাদের গ্রাম এখন খুব ভালো হয়েছে; আগে আমি একবারও যাই নি, তবে এখন যেতে চাই।

 

সেই বছরের শীতকালে মেয়ে সি মেই ফাং কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে সি বা তুং গ্রামে যেতে চান। ঠিক সেই শীতকালে লুং হাই তুং গ্রামে ফিরে যান। তিনি মেয়ে সি মেই ফাংকে নিজের বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান।

লুং হাই তুং সাংবাদিককে বলেন, আমি সি মেই ফাংকে বাসায় গিয়ে ঘরবাড়ি দেখার আমন্ত্রণ জানাই। তখন আমরা একসাথে খাবার রান্না করি। এরপর আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

 

২০১৯ সালে লুং হাই তুং ও সি মেই ফাং বিয়ে করেন। বিয়ে করার পর লুং হাই তুং গ্রামের প্রকৌশলী দলে কাজ করেন। স্ত্রী এক দিকে বাসায় শিশুর যত্ন নেন, অন্য দিকে গ্রামের মিয়াও জাতির সূচিকর্ম দলে কাজ শিখতে শুরু করেন। দু’জন ভবিষ্যত জীবন সম্বন্ধে খুব আশাবাদী হয়ে ওঠেন।

 

বর্তমানে গ্রামের অনেক অবিবাহিত ছেলে বিয়ে করতে সক্ষম হয়েছে। তারা ও তাদের পরিবার একসাথে সি বা তুং গ্রামের উন্নয়নের ধারায় যোগ দিয়েছে।

বর্তমানে সি বা তুং গ্রামে এতিহ্যবাহী শিল্প ছাড়া, পর্যটন শিল্প উন্নয়নে কাজ করছে। গ্রামটি সি বা তুং এই নামের ব্র্যান্ডও নিবন্ধন করেছে। প্রাকৃতিক কৃষিকাজ উন্নয়ন করছে। যেমন মিয়াও জাতির সূচিকর্ম, পশু পালন, ফল গাছ চাষ ইত্যাদি।

 

২০১৭ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করা ছেলে সি জি ছুনও গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি গ্রামের সমবয়সী ছেলের সঙ্গে গ্রামবাসীদের কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রি করতে সাহায্য করেন। গ্রামের জীবনযাত্রা এখন আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে, সি জি ছুনের মতো ছেলেদের চিন্তাধারার উন্নত হচ্ছে।

সঠিক পথ পাওয়া গেছে, প্রিয় মেয়েকে বিয়ে করেছে ছেলেরা। ২০১৯ সালের শেষ দিকে, সি বা তুং গ্রামের মাথাপিছু আয় ১৪ হাজার ৬৬৮ ইউয়ানে উন্নীত হয়েছে।