চীনা কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা বাড়ছে অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের
2022-02-21 13:02:25

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বৈশিষ্ট্যময় অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বিভিন্ন নিদর্শনও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উদ্যানে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। রাজধানী বেইজিংয়ের ঐতিহ্যিক হুথুং বা ‘প্রাচীন অলিগলি এলাকা’য় ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির ভিত্তিতে অনেক নতুন স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। আজকাল বিভিন্ন হুথুংয়ে নানা ধরনের হস্তকর্মের ওয়ার্কশপ দেখা যায়। চীনা মাটি, কাগজ কাটা, সূচিকর্মসহ বিভিন্ন শিল্পকর্মের প্রশিক্ষণ ক্লাস হয় এসব  ওয়ার্কশপে। চীনা কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এমন শিল্পের আকর্ষণ বেড়েছে। আজকের আমরা কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে জনপ্রিয় কিছু ওয়ার্কশপের তথ্য তুলে ধরবো।

বেইজিংয়ের মেয়ে চাং রুং সম্প্রতি নিয়মিত ছাওইয়াং এলাকার ৭৯৮ শিল্প এলাকায় যায়। সেখানে একটি ওয়ার্কশপ আছে। সেখানে সে ক্লোইসন এনামেল পেইন্টিংয়ের কাজ  উপভোগ করে। মেয়ে চাং বলে, এখন বেইজিংয়ের অনেক কিশোর-কিশোরী ছুটির দিনে ওয়ার্কশপে যায়। পিতামাতারা তাদের নিয়ে সেখানে বিভিন্ন হস্তশিল্পকর্ম তৈরির চেষ্টা করেন। ওয়ার্কশপ মাঝে মাঝে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানায়। তারা ক্লাস নেন এবং হস্তশিল্পকর্ম তৈরির বিস্তারিত পদ্ধতি বুঝিয়ে দেন। এ ধরনের কাজ সহজ নয় মোটেই। খুব মনোযোগ দিয়ে এ কাজ করা প্রয়োজন।

সাপ্তাহিক ছুটিতে ম্যাডাম ওয়াং তার বাচ্চাকে নিয়ে বেইজিং ছিয়ানমেন এলাকার ‘৯৩ নম্বর প্রাঙ্গণ’ নামের একটি ওয়ার্কশপে বেড়াতে যান। তিনি মনে জায়গাটা বাচ্চাদের খেলার জন্য চমত্কার। বাচ্চারা এখানে হাতের তৈরি টাই-ডাই আর ছোট বানর তৈরি করতে পারে। বেইজিংয়ের ঐতিহ্যিক হস্তশিল্পকর্ম ‘বানর’ আসলে চার ধরনের চীনা ভেষজ ওষুধ দিয়ে তৈরি করা হয়। শিল্পীদের সহায়তায় একটি ছোট লাভলি বানর বানিয়ে নিতে পারে বাচ্চারা। সেটি তাদের জন্য বেশ চমত্কার ও মজার ব্যাপার।

চীনের ঐতিহ্যিক হস্তশিল্প ও প্রযুক্তি এখন অনেক চীনা কিশোর-কিশোরীর জীবনের অংশ হয়ে গেছে। তাদের দৃষ্টিতে সেটি কেবল ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি নয়, বরং চমত্কার ফ্যাশনও বটে। যুবক ওয়াং হাও ফেই চীনের ছেংতু শহরের ওয়াংপিং রাস্তায় একটি ওয়ার্কশপ চালু করেছে। তাঁর দোকানে বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পকর্ম তৈরির পদ্ধতি শিখানো হয়। এখানে ঐতিহ্যিক চামড়ার অপেরার চিত্র আঁকা যায়। সেই চিত্র তৈরি শেষ হলে আলো ও সংগীতের সাথে মিশিয়ে একটি গল্প তুলে ধরা যায়। অনেকের জন্য বেশ আকর্ষণীয় ব্যাপার এটি।

চামড়া অপেরা বর্তমানে ঐতিহ্য থেকে আধুনিকতায় রূপান্তরিত হয়েছে। এ সম্পর্কে মালিক ওয়াং বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় তিনি কার্টুন শুটিং করার জন্য চামড়া অপেরার ওপর বিস্তারিত গবেষণা করতে শুরু করেন। তখন চামড়া অপেরা কেবল একটি সাংস্কৃতিক উপাদান হিসেবে বিজ্ঞাপন বা ডিজাইনে ব্যবহার করা হতো। তবে ধীরে ধীরে কিছু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান চামড়া অপেরার চিত্র তৈরির অনুশীলন ক্লাস চালু করে। বাচ্চারা সেটি বেশ পছন্দও করে। তখন থেকে তিনি চামড়া অপেরার সুউজ্জ্বল ভবিষ্যত বিবেচনা করে ব্যবসা চালু করতে শুরু করেন। ২০১৫ সালে ছেংতু শহরে তাঁর সাংস্কৃতিক সম্প্রচার কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে নিজেদের ব্র্যান্ডও নিবন্ধন করা হয়েছে।

ওয়াংয়ের দৃষ্টিতে বর্তমানে চীনা যুবকদের এখন আর কেবল সাংস্কৃতিক জ্ঞান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে না। তারা নিজেরাও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক শিল্পকর্ম তৈরির মজার অভিজ্ঞতা পেতে পারে। চলচ্চিত্র ও কার্টুন ফিল্মে চামড়া অপেরার চেয়ে আরও চমত্কারভাবে চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তোলা যায়। তবে চামড়া অপেরার সাহায্য দর্শকরা সরাসরি অভিনয়ের প্রক্রিয়া উপভোগ করতে পারে। তারা সরাসরি প্রদর্শনে অংশও নিতে পারে।

৯৩ নম্বর প্রাঙ্গণের কর্মীরা বলেন, অনেক পিতামাতা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে তাদের ওয়ার্কশপে আসে। এখানে তারা বিভিন্ন অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার শিল্পকর্ম তৈরি করতে পারেন; বাচ্চারাও হস্তশিল্পকর্ম তৈরির পদ্ধতি ও সাংস্কৃতিক বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে। যেমন, চীনা ভেষজ ওষুধের বানর, লর্ড খরগোশ, ময়দার ভাবমূর্তি, ঘুড়ি এবং খড় বুনাসহ বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরির পদ্ধতি তারা শিখতে পারে। ওয়ার্কশপের পাশে একটি ছোট জাদুঘর রয়েছে। সেখানে আরো বেশি তথ্য ও জ্ঞান জানা সম্ভব। অনেক বাচ্চা প্রতি সপ্তাহের ছুটিতে ওয়ার্কশপে আসে এবং ভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পকর্ম ক্লাসে অংশ নেয়।

চামড়া অপেরার উন্নয়নে মালিক ওয়াংও অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। গত কয়েক বছরে তিনি কোম্পানির সহকর্মীদের সাথে চামড়া অপেরার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল পণ্য নিয়ে গবেষণা করেন এবং ছেংতু’র মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের সঙ্গে  সহযোগিতা ভিত্তিতে কাজ করেছেন। আর এসবের উদ্দেশ্য ছিল, চামড়া অপেরার প্রতি বাচ্চাদের আগ্রহ সৃষ্টি করা।

সম্প্রতি চীনের বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার ‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’ চালু হয়েছে। এতে বাচ্চাদের গুণগত মানের শিক্ষা যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির সাথে তাদের চিনপরিচয় হবার সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। চামড়া অপেরা অতীতকালেন চীনাদের লোকশিল্পের অন্যতম। ঐতিহ্যিক অপেরার অনেক গল্প মানুষের নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব দেয়। পিতামাতাকে সম্মান করা ও যত্ন নেওয়ার সবদ দেয় এমন অপেরা।

বর্তমানে শিক্ষাদানের তত্ত্ব ও পদ্ধতি বহুমুখী হয়েছে। মালিক ওয়াংয়ের দৃষ্টিতে চামড়া অপেরাও মজার শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিণত হতে পারে। বাচ্চারা চামড়া অপেরায় অভিনয় করতে পারে এবং বিভিন্ন চামড়া অপেরার চিত্রও নিজেরা আঁকতে বা তৈরি করতে পারে। তারা নিজেদের গল্পের বিষয় অনুসারে ভিন্ন সংগীতসুর সৃষ্টি করতে পারে।

পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ইউনেস্কোর অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের নামতালিকায় চীনের উত্তরাধিকারের সংখ্যা ছিল ৪২টি, যা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সূত্র থেকে জানা গেছে, চীনের বিভিন্ন ধরনের অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সংখ্যা ৮ লাখ ৭০ হাজারের বেশি। হাজার বছরের ইতিহাস অতিক্রম করে ঐতিহ্যিক শিল্প কিভাবে আধুনিক চীনা সমাজ সমৃদ্ধ করছে? এটা সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার শিল্পীদের বিবেচনার বিষয়।

সৃজনশীল কাগজ কাটার শিল্পী হিসেবে যুব শিক্ষিকা ইয়াং হুই জি কাগজ কাটার ক্লাস বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর এ ক্লাস কেবল শিল্প বিষয়ক ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে তা নয়, বরং অন্যান্য মেজরের শিক্ষার্থীদেরও আকর্ষণ করেছে। প্রতিটি উত্সব বা সুখের ব্যাপারে কাগজ কাটা চীনাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রীতিনীতি, যা চীনের লোকশিল্পের প্রতীক। শিক্ষক ইয়াং বলেন, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে কেবল মৌলিক কাগজ কাটার পদ্ধতি ও দক্ষতা অর্জন করে তা নয়, বরং কাগজ কাটার বিভিন্ন আকারের ডিজাইনের সাংস্কৃতিক অর্থ সম্পর্কে জানতে পারে। এভাবে তারাও আধুনিক কাগজ কাটা শিল্পে সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে পারে।

প্রায় ৬ বছর আগে শিক্ষক ইয়াং বন্ধুদের সাথে বেইজিংয়ের নানলুওকুসিয়াং বাণিজ্যিক এলাকায় একটি ওয়ার্কশপ চালু করেন। তখন থেকে বিভিন্ন ধরনের কারুশিল্প ক্লাস চালু করেন তিনি। তিনি অন্যান্য সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ক্লাস নেওয়ান। বিশেষ করে বাচ্চাদের মধ্যে কারুশিল্পের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা তাঁর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তবে পরে ব্যবসা এলাকার রাস্তা নির্মাণ কাজের কারণে ওয়ার্কশপ বন্ধ করে দেওয়া হয়। গত বছরের শেষ দিকে তিনি বেইজিংয়ের উপকন্ঠ এলাকা শুন’ইতে নতুন ওয়ার্কশপ চালু করেন। সেখানে তাঁর বাড়ির কাছে, অনলাইনে উইচ্যাটের মাধ্যমে দোকান খোলেন। দোকানে নিজের ডিজাইনের কাগজ কাটার কারুশিল্পকর্ম বিক্রি করেন তিনি।

পরিসংখ্যান তেকে জানা গেছে, চীনের অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সাথে জড়িত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩০০০টিরও বেশি। এ শিল্পের ব্যবসা এখন আকর্ষণীয়। চামড়া অপেরা দোকানের মালিক ওয়াং বলেন, তার দোকানের ক্রেতারা চামরা অপেরার প্রতি অনেক আগ্রহ ও কৌতূহল দেখায়। তবে চলচ্চিত্রের সাথে তুলনা করলে চামড়া অপেরা তেমন একটা সুপরিচিত নয়। তাই গ্রাহকদের সংখ্যা একটু কম। তা ছাড়া, চামড়া অপেরার কাঁচামাল খুবই দামী। তাই এখন বিভিন্ন চিত্র তৈরিতে সস্তা কাঁচামাল খোঁজেন তিনি। এতে খরচ কমবে ও ক্রেতারাও কম দামে কিনতে আগ্রহী হবে।

কাগজ কাটার শিল্পী শিক্ষক ইয়াং মনে করেন, চীনের শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কারের নতুন সুযোগ কাজে লাগিয়ে নান্দনিক শিক্ষা আরও উন্নত করা সম্ভব। অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ওয়ার্কশপ বেশ ভালো একটি পদ্ধতি। এতে চীনা কিশোর-কিশোরীরা সঠিকভাবে স্বদেশের সংস্কৃতি উপভোগ করতে পারে এবং এতে তাদের সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাসও বাড়ছে। অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ক্লাস ও স্কুলের ঐতিহ্যিক ক্লাসের সমন্বয়ের জন্য স্কুলগুলোকে অনেক কাজ করতে হবে।

চীনা সমাজ অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে ব্যাপক স্বীকৃতি দিলে ব্যবসার বাজারও সম্প্রসারিত হবে। মুনাফা ও আবেগ থাকলে এ কাজ সুষ্ঠুভাবে উন্নত করা যাবে। সম্প্রতি চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, চীনের সুন্দর গ্রাম গড়ে তোলা ও গ্রামাঞ্চলের পুনরুজ্জীবন বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট এলাকায় অবৈষয়নিক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ওয়ার্কশপ নির্মাণ করা হবে। এভাবে বিভিন্ন এলাকায় দর্শনীয় স্থান উপভোগ করার পাশাপাশি, স্থানীয় অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে আরও জানার সুযোগ পাবেন পর্যটকরা।

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)