সবুজ শীতকালীন অলিম্পিক বিশ্বকে দেয়া চীনের নতুন উপহার
2022-02-21 16:21:24

বেইজিং শীত্কালীন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আলোক অনুষ্ঠান বিশ্বের অসংখ্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাতে দেখা যায়, দু’জন মশালবাহক অলিম্পিকের মশালটিকে “বড় তুষারকণার” মাঝখানে রেখেছেন এবং এটি ধীরে ধীলে রাতের আকাশে উঠছে। কোন কোন বিদেশি নেটিজেন বলেছেন, চীনের এই আচরণ দেশটির দূষণমুক্ত জ্বালানী ব্যবহারের প্রধান অনুশীলনকারী হবার প্রমাণ। পাশাপাশি, এটি পরিবেশ সংরক্ষণ সচেতনতায় বিশ্ব উদ্যোক্তার লক্ষণ বহন করে।

 

বেইজিং শীত্কালীন অলিম্পিক গেমসের ‘চারটি ধারণা’য় “সবুজ” প্রথম স্থান পায়। শীত্কালীন অলিম্পকি ভেন্যুর ভেতর ও বাইরে সবুজ উপাদান এবং নিম্ন-কার্বন ধারণা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সারা বিশ্বকে চীন তার দূষিত পদার্থের নির্গমন হ্রাসের প্রতিশ্রুতি পালনের আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টা দেখিয়েছে।

 

প্রথমবারের মতো হাইড্রোজেন শক্তি মশালের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং সকল ভেন্যুতে শতভাগ সবুজ বিদ্যুত্ সরবরাহ করা হয়েছে। জাতীয় স্পিড স্কেটিং ওভাল অর্থাত্ “বরফ বেল্ট”-কে সরাসরি কুলিং সিস্টেম বরফ তৈরির এভিনিউ স্পিড স্কেটিং হলে পরিণত করা হয়। তাই বেইজিং শীত্কালীন অলিম্পিক গেমসের রিপোর্ট করার সময় বিদেশি তথ্যমাধ্যমে  সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দগুলোর অন্যতমে পরিণত হয়েছে “সবুজ”।

 

সিঙ্গাপুরের লিয়েন হো মর্নিং নিউজ পত্রিকা জানায়, এবারের শীত্কালীন অলিম্পিক গেমসের প্রধান বিষয় “সবুজ অলিম্পিক আয়োজন”। ২০২০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হওয়া জাং বেই নবায়নযোগ্য শক্তির নমনীয় ডিসি পাওয়ার গ্রিড পরীক্ষামূলক ও দৃষ্টান্তমূলক প্রকল্প হচ্ছে শীত্কালীন অলিম্পিকের সবুজ বিদ্যুত্ সরবরাহ বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। পাশাপাশি, বিশ্বকে দেখানো চীনের একটি “সবুজ রিপোর্ট কার্ড”।

 

এএফপি মনে করে, চীন বেইজিং শীত্কালীন অলিম্পিক গেমসের মাধ্যমে তার সবুজ বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করেছে। চীন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, শুধু বায়ু, জল ও সৌর—এই তিন ধরনের শক্তি থেকে শীত্কালীন অলিম্পিক গেমসের জন্য বিদ্যুত্ সরবরাহ করা হবে। শীত্কালীন অলিম্পিক গেমসের তিনটি কেন্দ্রের অন্যতম হিসেবে জাং চিয়া খৌ শহরে ১.৪ কোটি কিলোওয়াটের বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। যা প্রায় পুরো সিঙ্গাপুরে সরবরাহকৃত  বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে পারে। চীন সরকার পাহাড়ি অঞ্চলে সৌর প্যানেল স্থাপন করেছে। জানা গেছে, এসব সৌর প্যানেল প্রায় ৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করে। এ ছাড়া, চীন বিশেষ একটি শক্তির কারখানা নির্মাণ করেছে। নবায়নযোগ্য শক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুত্ উত্পাদন করার পর সেখানে তা জমা করে সকল ভেন্যুতে হস্তান্তর করা হয়, যাতে বিদ্যুত্ সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন করা যায়।

 

বিদেশি তথ্যমাধ্যম বিশ্বাস করে, বেইজিং শীত্কালীন অলিম্পিক গেমসের মাধ্যমে বিশ্ব চীনের সবুজ উন্নয়নে দৃঢ় প্রত্যয় দেখেছে।

 

২০২০ সালে চীন বিশ্বের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, ২০৩০ সালের আগে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হ্রাস করা শুরু করবে এবং ২০৬০ সালের আগে কার্বন নিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালাবে। “দু’টো কার্বন” লক্ষ্যবস্তু বাস্তবায়ন করার জন্য চীন বেশ কিছু নীতি ও ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে। এই বিষয়ে ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত সিপিসির একটি প্রস্তাব বিদেশি তথ্যমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

 

এএফপি ওই “প্রস্তাব”-এর বরাতে জানায়, ২০২৫ সালে মোট দেশজ উত্পাদন তথা জিডিপি’র কার্বনডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ২০২০ সালের চেয়ে ১৮ শতাংশ কমাবে চীন। ২০৩০ সাল পর্যন্ত তা ২০০৫ সালের চেয়ে ৬৫ শতাংশেরও বেশি কমাবে। তখন অ-জীবাশ্ম শক্তি খরচ ২৫ শতাংশে পৌঁছাবে। বায়ু শক্তি ও সৌর শক্তির বিদ্যুৎ উৎপাদনের মোট ক্ষমতা ১.২ বিলিয়ন কিলোওয়াটের বেশি হবে।

 

ফ্রান্সের “এল'এক্সপ্রেস” ওয়েবসাইট মনে করে, চীন “দু’টো কার্বন” এবং নতুন বিদেশি কয়লা বিদ্যুত্ প্রকল্প  আর নির্মাণ না করার লক্ষ্যবস্তু ঘোষণা করেছে, যা সন্দেহাতীতভাবে দেশটিকে নবায়নযোগ্য শক্তি উন্নয়নের সামনে দাঁড় করাবে।

 

রয়টার্সের খবরে বলা হয়, ২০২১ সালের ৩ ডিসেম্বর চীনের শিল্প ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে “চতুর্দশ পাঁচশালা পরিকল্পনা”র শিল্পের সবুজ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা প্রকাশ করে। এর লক্ষ্য হলো কার্বন নিঃসরনের তীব্রতা ধারাবাহিকভাবে কমানো, দূষণকারী নির্গমনের তীব্রতা স্পষ্টভাবে কমানো, জ্বালানী কার্যকারিতা স্থিতিশীলভাবে উন্নত করা, সম্পদ ব্যবহারের মান স্পষ্টভাবে উন্নত করা এবং সবুজ উত্পাদন ব্যবস্থা দিন দিন সুসম্পূর্ণ করা।

 

আরো ভালোভাবে জ্বালানী সাশ্রয় ও দূষিত পদার্থের নির্গমন হ্রাস ত্বরান্বিত করার জন্য চীন অব্যাহতভাবে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের প্রযুক্তি গবেষণা ও উন্নয়ন দ্রুততর করে স্বতন্ত্র উদ্ভাবনী দক্ষতা বাড়ায়।

 

“লিয়ন হো মর্নিং পত্রিকা” বলছে, ২০২১ সালের শেষ নাগাদ ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় কার্বন নিরপেক্ষতা অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছে। অ্যাকাডেমিটি কার্বন নিরপেক্ষতাকে কেন্দ্র করে প্রযুক্তি উদ্ভাবন কেন্দ্র, উচ্চ মানের থিঙ্ক ট্যাংক কেন্দ্র, উচ্চ পর্যায়ের মেধাশক্তি প্রশিক্ষণ ঘাঁটি এবং সহযোগিতামূলক বিনিময় প্রচার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবে। এ ছাড়া, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নর্থওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, শাংহাই চিয়াওথোং বিশ্ববিদ্যালয় ও ফুচিয়ান নরমাল ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় কার্বন নিরপেক্ষতা-বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে।

 

বিবিসি চীনের নতুন জ্বালানী গাড়ির উপর মনোযোগ দিয়েছে। জানা গেছে, চীন সরকার ও গাড়ি খাতের প্রতিনিধিদের গবেষণা ও আন্দাজ অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের আগে চীনে বিক্রিত প্রায় সকল নতুন গাড়ি বিশুদ্ধ বৈদ্যুতিক বা হাইব্রিড নতুন শক্তির গাড়ি হবে। বিবিসি বলছে, পরিবহনে জ্বালানী ছাই করে এবং প্রায় একচতুর্থাংশ কার্বন নির্গমন সৃষ্টি করে। পাশাপাশি, গাড়ি বৃহত্তম নির্গমনকারী। এ প্রেক্ষাপটে চীন ব্যাপকভাবে নতুন শক্তির গাড়ি উন্নয়ন করে গ্রীনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাবে।

 

জ্বালানী সাশ্রয় এবং দূর্ষিত পদার্থের নির্গমন হ্রাসে চীনের অগ্রগতি ও ফলাফল অন্যান্য দেশকে সবুজ উন্নয়নে কল্যাণকর জ্ঞানদান দেয়। চীনের অবদান আন্তর্জাতিক সমাজের ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেছে।

 

পাকিস্তানের বিশ্ব কৌশল গবেষণা কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এক প্রবন্ধে বলেন, চীন ধারাবাহিকভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অন্যান্য দেশ চীনের অনেক ব্যবস্থা ও অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারবে।

 

(প্রেমা/এনাম)