তু লুং জাতি: পুরো জাতির একসাথে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার গল্প
2022-02-18 18:48:31

তু লুং জাতি: পুরো জাতির একসাথে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার গল্প

চার পাশে খাড়া উঁচু পাহাড়; গ্রাম থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য ‘আকাশের সিঁড়ি’ মতো খাড়া কাঠের সেতু ব্যবহার করা হয়। যে কোনও মুহূর্তে গিরিখাতে পড়ে মারা যাওয়ার আশংকা রয়েছে। এ অবস্থায় মানুষের জীবন কত কঠিন হতে পারে? এখন সেখানে মানুষের জীবনে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি? 

এই ছোট গ্রামের নাম তু লুং চিয়াং গ্রাম। যা চীনের কাও লি কুং পাহাড়ের রাষ্ট্রীয় প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকার কেন্দ্রে অবস্থিত। পুরো গ্রামের আয়তন ১৯৯৭.৩ বর্গকিলোমিটার। স্থানীয় অধিবাসীর মধ্যে ৯৯ শতাংশই তুলুং জাতির  মানুষ।

চীনের ম্যাপে, দু লুং চিয়াং গ্রামকে চিহ্নিত করা কঠিন বিষয় নয়। ইয়ুননান প্রদেশের সবচেয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে, তিব্বত ও মিয়ানমারের সীমান্তে গ্রামটি অবস্থিত। এ জায়গা সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে এবং সেখানে কম মানুষই যায়। চারপাশে খাড়া উঁচু তুষারমৌলি পাহাড়। গিরিখাত অনেক গভীর। পূর্ব দিকের কাও লি কুং পাহাড়- গ্রামের বাইরে যাওয়ার সব পথ বন্ধ করে রেখেছে। গ্রামের সবচেয়ে উঁচু এলাকাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৯৬৩ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত।

 

ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক কারণে তু লুং চিয়াং গ্রামের প্রাকৃতিক অবস্থা খুব জটিল ও বিপদসঙ্কুল। জায়গাটি ইয়ুননান প্রদেশ এবং গোটা দেশের অন্যতম গরিব এলাকা। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার আগে তু লুং জাতি যেন আদিম সমাজের অংশ ছিল। বাইরে যাওয়ার জন্য লোকজনকে শুধু পাহাড়ের মধ্যে ‘আকাশের সিঁড়ির’ মতো বেতের সেতু দিয়ে পার হতে হতো। পাহাড় আর পাহাড়ের মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ অনেক কম। সবখানে খাড়া উঁচু পাহাড়, সাবধান না হলে বিপদে পড়তে হবে। লোকজন বাড়িঘর নির্মাণ করতে চাইলে, উপযোগী জমি খুঁজে বের করতে হয়। লম্বা বা ছোট কাঠ দিয়ে বাড়িঘরকে মাটি থেকে উঁচুতে ওঠাতে হয়। ছোট নদী বাড়িঘরের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যায়।

 

১৯৬৪ সালে কুংশান জেলা থেকে তুং লুং চিয়াং গ্রাম যেতে মোট ৬৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের post road তৈরি করা হয়। ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, ৯৬.২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের তু লুং চিয়াং সড়ক পথ চালু হয়। এর মাধ্যমে চীনের সব সংখ্যালঘু জাতি অধ্যুষিত এলাকায় সড়কপথ চালু করার কাজ সম্পন্ন হয়। তু লুং চিয়াং যেতে আগের ৪/৫ দিন সময় লাগত। এখন সেই সময় কমে হয়েছে মাত্র ৭/ ৮ ঘণ্টা।

 

তু লুং চিয়াং গ্রামের পাশে দু’টি বড় পাহাড় রয়েছে। যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চার হাজার ফুটেরও বেশি উঁচু। এবং পুরো বছর সেখানে তুষার জমে থাকে। তু লুং চিয়াং গ্রামে যাওয়ার সড়কপথ প্রতি বছর নভেম্বর মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রচুর তুষারের কারণে বন্ধ হয়ে থাকে। তুষারের পাহাড় যেন একটি খাড়া-উঁচু দেয়ালের মতো; যা তু লুং চিয়াং গ্রামটি ঘিরে রেখেছে। বাইরের মানুষ গ্রামে ঢুকতে পারে না, গ্রামের লোকজনও বাইরে যেতে পারে না। তুষার পুরো পাহাড়ি এলাকাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। এসময় পথের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। লোকজন প্রাণের ঝুঁকিতে থাকে। তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে পাহাড় পার হতে হয়। মানুষ কাঁধে করে ও ঘোড়ার মাধ্যমে হেঁটে হেঁটে ৫/৬ দিন সময় নিয় তু লুং চিয়াং গ্রাম পৌঁছাতে হয়। আর শীতকালে ঘন ঘন তুষার ধসের ঘটনা ঘটে। তু লুং চিয়াং গ্রামে এক বোতল মদের দাম অন্যান্য জেলার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি।

 

লোকজনের জীবনের এই কঠিন সমস্যা সমাধানের জন্য ২০১০ সালে ৭৮ কোটি ইউয়ান বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই অর্থ দিয়ে তু লুং চিয়াং সড়ক নির্মাণকাজ শুরু হয়। নতুন করে ৬.৬৮ কিলোমিটারের তু লুং চিয়াং টানেল কাও লি কুং পাহাড় পার হয়ে যায়। এর মাধ্যমে তু লুং চিয়াংয়ের সড়ক আগের ৯৬.২ কিলোমিটার থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৭৯.৯৮২ কিলোমিটারে।

 

২০১৪ সালের শুরুতে কুং সান জেলার কর্মকর্তা ও জনসাধারণ চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে চিঠি লিখে স্থানীয় অর্থনীতি, সমাজ ও জীবনের মান উন্নয়নের কথা জানান। প্রেসিডেন্ট সিকে তাদের বহু বছরের আকাঙ্ক্ষিত তু লুং চিয়াং সড়কের টানেল চালু হওয়ার সুখবর জানান তারা। প্রেসিডেন্ট চিঠি পাওয়ার পর পরই তাদেরকে জবাবি চিঠি লিখে অভিনন্দন জানান। তিনি আশা করেন, তু লুং জাতির জনগণ দারিদ্র্যবিমোচন বাস্তবায়ন করতে পারবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভাইবোনের সঙ্গে সচ্ছল জীবনের সুন্দর স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।

 

২০১৪ সালের শেষ নাগাদ ৬.৬৮ কিলোমিটারের কাও লি কুং পাহাড়ের তু লুং চিয়াং টানেল আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। এর মাধ্যমে তু লুং চিয়াং গ্রামটি তুষারের কারণে অবরুদ্ধ থাকার ইতিহাসের অবসান ঘটে। বাইরের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন তু লুং চিয়াং গ্রাম অবশেষে সবার কাছে নিজের সৌন্দর্য তুলে ধরতে পারে। বিভিন্ন স্থানের মানুষ সেই গ্রামে পর্যটনের জন্য যেতে পারে। এতে সেখানকার অসাধারণ সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, সরল রীতিনীতি উপভোগ করার সুযোগ হয়। সুবিধাজনক সড়কব্যবস্থার মাধ্যমে এখন তু লুং জাতির মানুষ মাত্র ৩ ঘণ্টার মধ্যেই জেলায় পৌঁছাতে পারে।

 

তু লুং জাতির জনগণের প্রতি প্রেসিডেন্ট সি’র যত্নের খবর কিন্তু এ পর্যন্তই নয়!

২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে, প্রেসিডেন্ট সি ইয়ুননান প্রদেশ পরিদর্শন করেন। তিনি কাও লি কুং পাহাড়ের টানেল নির্মাণ কাজের কথা মনে রেখেছিলেন। তু লুং জাতির জনগণের জীবনের পরিবর্তনের প্রতি গুরুত্ব দেন তিনি। তাদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তিনি সেবার উদ্যোগ নেন। তাঁর পরিদর্শনের সময়সূচী টাইট হলেও, প্রেসিডেন্ট সি তাঁকে চিঠি লেখা তু লুং জাতির ৫জন কর্মকর্তা এবং দুইজন তু লুং জাতির নারীকে খুন মিং শহরে আমন্ত্রণ জানান। তিনি তাদের সঙ্গে দেখা করেন।

 

সেই সাক্ষাতে প্রেসিডেন্ট সি জনসাধারণের জীবনের অবস্থা খুব বিস্তারিত জানতে চান। একটি নতুন বাড়ি নির্মাণে কত খরচ প্রয়োজন হয়? আগে পাহাড় থেকে বের হতে কত সময় লাগত- ইত্যাদি নানা কথা জানতে চান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।

 

সাক্ষাতের সময় প্রেসিডেন্ট সি বলেন, আজ আমি খুব খুশি, তু লুং জাতির প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করতে পেরেছি। তু লুং জাতির নাম দিয়েছেন চীনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। যদিও এই জাতির লোকসংখ্যা মাত্র ৬৯০০জন; তবুও তা চীনা জাতির সদস্য। চীনে, চীনা জাতির বড় পরিবারে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে, তু লুং জাতির মানুষ বিভিন্ন জাতির জনগণের সঙ্গে কাজের চেষ্টা করছে এবং সার্বিক সচ্ছল সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।

 

প্রেসিডেন্ট সি উল্লেখ করেন, তু লুং জাতি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতির মানুষের জীবনের আকাশ-পাতাল পরিবর্তন প্রমাণ করে যে চীনের বৈশিষ্ট্যময় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সত্যিই কার্যকর হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে। সবার উচিত ভালোভাবে নিজের কাজ করে যাওয়া।

 

তু লুং চিয়াং গ্রামে দারিদ্র্যবিমোচন নীতির সাহায্যে স্থানীয় লোকজনের জীবনমান অনেক উন্নত করেছে। ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ তু লুং চিয়াং গ্রাম সম্পূর্ণ দারিদ্র্যমুক্ত হয়। ‘সার্বিক সচ্ছল সমাজ গড়ে তোলা, সব জাতির যৌথভাবে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা’ হলো সারা দেশের জনগণের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা। যা সি চিন পিং-কেন্দ্রিক সিপিসি সরকারের দৃঢ় সংকল্প। তু লুং জাতির দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার খবর শুনে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং খুব খুশি হয়েছেন।

 

বর্তমানে তু লুং চিয়াং গ্রামের ১০৮৬টি পরিবার আগের জরাজীর্ণ জীবনকে সম্পূর্ণ বিদায় জানিয়েছে; সবাই নিরাপদ, আরামদায়ক ও সুন্দর বাড়িঘরে স্থানান্তরিত হয়েছে। সব গ্রামের পথঘাট নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। বিদ্যুত, ইন্টারনেট, টেলিযোগাযোগ, রেডিও, টিভি, নিরাপদ পানীয় জলসহ নানা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সব মানুষ চিকিত্সা বীমা ও অবসর বীমা উপভোগ করছে। গুরুতর রোগ হলেও সমস্যা নেই। কিন্ডারগার্টেন থেকে উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত তু লুং জাতির শিশুরা ১৪ বছর বিনা খরচে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তু লুং চিয়াং গ্রামের চেহারা একদম পাল্টে গেছে।

 

স্থানীয় লোকজন বলে, আগে তারা প্রতিদিন শুধু ভুট্টা খেত। মাংস ও ডিম পুরো বছর শুধু এক বার খাওয়া যেত। এখন সাদা চাল পাওয়া যায়, তাদের সুন্দর বাড়িঘর আছে; মাংস, ফল- যা খেতে ইচ্ছে করে, সেটাই খাওয়া যায়। বাসায় টিভি, ফ্রিজার, সব কিছু আছে। জীবন আরো মিষ্টি হয়ে উঠেছে।

 

তু লুং চিয়াং গ্রামের আবহাওয়া ধান ও ভুট্টা চাষের জন্য উপযুক্ত। তা ছাড়া তু লুং জাতির মানুষ বনের মাঝামাঝি স্ট্রবেরি, চা, মাশরুমসহ বিভিন্ন জিনিস চাষ করে। তু লুং মুরগি, গরু লালন-পালন করে। ২০০৯ সালে তু লুং চিয়াং জাতির মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র মাত্র ৯শ’ ইউয়ান। ২০১৮ সাল শেষ নাগাদ, সেখানে গ্রামীণ অর্থনীতির মোট পরিমাণ ২ কোটি ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়। লোকজনের মাথাপিছু আয় ৬১২২ ইউয়ানের বেশি হয়। যা দশ বছরে ৭ গুণেরও বেশি হয়েছে।