সবুজ উন্নয়নে সারা বিশ্বে অবদান রাখছে চীন
2022-02-14 14:41:49

মানবজাতির অস্তিত্ব ও উন্নয়নে জলবায়ু পরিবর্তনের ডেকে আনা গুরুতর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবুজ উন্নয়ন বিভিন্ন দেশের অভিন্ন স্বার্থের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। উচ্চমানের ‘এক অঞ্চল এক পথ’ নির্মাণের প্রক্রিয়ায় চীন সবসময় সবুজ উন্নয়ন ধারণার ভিত্তিতে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে হাতে হাত রেখে আরো ঘনিষ্ঠ সবুজ উন্নয়নের অংশীদারি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করছে। চীনের দ্বারা বাস্তবায়িত বেশ কিছু সবুজ প্রকল্প কার্যকরভাবে স্থানীয় টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করছে। বিশ্ব পরিবেশ প্রশাসন ত্বরান্বিত করা, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটি সুন্দর পৃথীবি নির্মাণেও বাস্তব অবদান রাখছে চীন।

 

বালির সাগরে সৌর গ্রাম

 

দক্ষিণ মিসরের আসওয়ান প্রদেশে সূর্যালোকের কমতি নেই। বছরজুড়ে সেখানে সূর্যালোকের মোট সময় ৩ হাজার ঘন্টারের বেশি। সেখানকার মরুভূমিতে দেশটির প্রথম ‘সৌর গ্রাম’ তথা বিশ্বের বৃহত্তম সৌর শিল্প পার্কগুলোর অন্যতম--বেনবান সৌর শিল্প পার্ক--তৈরি করে দেশটির সবুজ জ্বালানী উন্নয়নের জন্য নতুন চালিকাশক্তি সরবরাহ করছে।

 

২০২০ সালের জানুয়ারিতে চীনের জেচিয়াং প্রদেশের চিন্ট নামক প্রতিষ্ঠানের নির্মিত ১৬৫.৫ মেগাওয়াট বেনবান সৌর প্রকল্পটি মিসরের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর থেকে চীনা দল নিয়মিত অনলাইনে মিসরকে প্রযুক্তিগত সমর্থন দিয়ে আসছে। “চীনা প্রতিষ্ঠানের উচ্চতর নির্মাণ কাজ, স্থায়ী প্রযুক্তি পরিষেবা ইত্যাদি প্রকল্পের স্থিতিশীল চালু নিশ্চিত করেছে।” প্রকল্পটির পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ম্যানেজার এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, এই প্রকল্পটি ডিজাইন, সরঞ্জাম গবেষণা ও উন্নয়ন সমাবেশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিসরের সৌর শিল্পের উন্নয়নে মূল্যবান অভিজ্ঞতা দিয়েছে।

 

“মিসর সরকার সবসময় বিদ্যুত সংকট সমাধানের চেষ্টা চালায়। বর্তমানে সমস্যা কার্যকরভাবে প্রশমিত হয়েছে”।  মিসরের “আল আহরাম” ওয়েবসাইটে বলা হয়, যৌথভাবে “এক অঞ্চল এক পথ” নির্মাণ কাঠামোয় মিসর-চীন দূষণমুক্ত জ্বালানী সহযোগিতা ফলপ্রসূ হয়েছে। কার্যকরভাবে দেশটির জ্বালানী কাঠামো উন্নত করার মাধ্যমে দেশটির সবুজ উন্নয়ন এবং অর্থনীতির টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়তা সরবরাহ করেছে।

 

পূর্ব আটলান্টিকের এক একটি  বায়ু ঘূর্ণযন্ত্র দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তরের কেপ প্রদেশের  দে আর জেলার বিশাল পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা রঙের পাখাগুলো আস্তে আস্তে ঘুরে দূষণমুক্ত বিদ্যুত্ উতপাদন করছে। ফলে ৩ লাখ স্থানীয় অধিবাসী নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত পাচ্ছে। এটি চীনের লোং ইউয়ান পাওয়ার গ্রুপের দক্ষিণ আফ্রিকা কোম্পানি নির্মিত দে আর বায়ু-বিদ্যুত্ প্রকল্প। পাশাপাশি, দেশটির উত্পাদনে থাকা বৃহত্তম বায়ু-বিদ্যুত্ প্রকল্পগুলোর অন্যতম এটি।

 

দক্ষিণ আফ্রিকার বিদ্যুত্ সরবরাহ কাঠামোতে তুলনামূলকভাবে তাপ শক্তির হার ৯০ শতাংশেরও বেশি। দেশটির জ্বালানী মন্ত্রণালয় ২০৩০ সাল পর্যন্ত জলবিদ্যুত্ ছাড়া অন্যান্য টেকসই জ্বালানী বিদ্যুত্ উত্পাদনের হার ১৪.৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করার লক্ষ্য উত্থাপন করেছে। সাম্প্রাতিক বছরগুলোতে অনেক চীনা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ আফ্রিকায় স্থানীয় দূষণমুক্ত জ্বালানীর উদ্ভাবনে সহায়তা করছে।

 

২০১৭ সালে দে আর বায়ু-বিদ্যুত্ প্রকল্প চালু হয়। প্রতি বছর  প্রায় ৭৬ কোটি কিলোওয়াট ঘন্টা দূষণমুক্ত বিদ্যুত্ সরবরাহ করে থাকে এই প্রকল্প। তার মানে প্রায় ২ লাখেরও বেশি টন স্ট্যান্ডার্ড কয়লা বেঁচে যায় এবং ৬ লাখেরও বেশি টন কার্বনডাই-অক্সাইড নির্গমন হ্রাস পায়। প্রকল্পটি দেশটির প্রথম এবং একমাত্র আন্তর্জাতিক কার্বন সিঙ্ক ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম—ভেরা-তে সাফল্যের সঙ্গে নিবন্ধিত কার্বন নির্গমন হ্রাস প্রকল্প, যা পরিবেশ ও অর্থনীতির কার্যকারিতা লাভ করেছে। প্রকল্পের দায়িত্বশীল এক ব্যক্তি বলেন, প্রকল্পটি কার্যকরভাবে দেশটির কিছু অঞ্চলের বিদ্যুতের অভাব প্রশমণ করেছে। মহামারী প্রতিরোধ চলাকালে বায়ু-বিদ্যুত্ কেন্দ্র নিরাপদে ও স্থিতিশীলভাবে চালু রয়েছে। ফলে দূষণমুক্ত বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

 

দে আর বায়ু-বিদ্যুত্ প্রকল্পের নির্মাণ ও পরিচালনা শুধু স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে- তা নয়, বরং সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা কার্যকর করার মাধ্যমে স্থানীয় জ্বালানী শিল্প উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তিগত মেধাশক্তি পরিচর্যা করছে। ২০১৮ সাল থেকে লোং ইউয়ানের দক্ষিণ আফ্রিকার কোম্পানি প্রতি বছর প্রায় ১৬.৬ লাখ ইউয়ান বরাদ্দ দিয়ে কেপ প্রদেশের ৪০ জন দারিদ্র্য কিন্তু মেধাবী ছাত্রকে সহায়তা দেয়। এ ছাড়া, পরিকল্পনার আওতার ছাত্রছাত্রীরা  প্রকল্পে অনুশীলন করতে পারছে।

 

উত্তর কেপ প্রদেশের একজন কর্মকর্তা ভবিষ্যতে দু’পক্ষ সবুজ জ্বালানী ক্ষেত্রে আরো বেশি সহযোগিতা চালিয়ে দেশটির এমনকি আফ্রিকার সবুজ উন্নয়ন বাস্তবায়ন করার প্রত্যাশা করে বলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকা-চীন সহযোগিতামূলক দে আর বায়ু-বিদ্যুত্সহ বিভিন্ন জ্বালানী প্রকল্প দেশটির তাপ শক্তির ওপর নির্ভরতা হ্রাস এবং দূষণমুক্ত জ্বালানী উদ্ভাবন-সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং কার্যকরভাবে স্থানীয় জ্বালানী কাঠামোর সুবিন্যাস করছে”।  

 

“মাতৃ নদী”  আবারও  পরিষ্কার হয়েছে

 

সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেদকে “বলকানের চাবি” বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেখানে দূষিত পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। শহরের প্রায় একতৃতীয়াংশ অঞ্চলে নর্দমা নেই।

 

দেশটির গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন বেলগ্রেদের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে এক সেট সম্পূর্ণ দূষিত পানি সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা সরবরাহ শুরু করে। দৈনিক দূষিত পানি নিষ্পত্তির পরিমাণ ৪ লাখ ৪৮ হাজার বর্গমিটারে পৌঁছেছে। বার্ষিক দূষিত পানি নিষ্পত্তির পরিমাণ শহরের ১৫ লাখ বাসিন্দাদের কভার করবে এবং নিষ্পত্তির পর দূষিত পানি পুরোপুরিভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মানদণ্ড পূরণ করবে।

 

দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রকল্পটি বেলগ্রেদের জন্য বিপুল গুরুত্বপূর্ণ এবং দীর্ঘকালে পৌর সরকার ও অধিবাসীদের সমস্যা সমাধান করে স্থানীয় অধিবাসীদের জীবনযাপনের গুণগতমান উন্নত করবে।

 

শ্রেষ্ঠ নির্মাণ পরিকল্পনা খুঁজে বের করার জন্য চীনা প্রতিষ্ঠানটি শহরের ১২টি জায়গায় দূষিত পানির মান ও পরিমাণ তত্ত্বাবধান সরঞ্জাম স্থাপন করে। শহরের দূষিত পানির ওপর দেড় বছরের তত্ত্বাবধান এবং পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে স্থানীয় পরিস্থিতির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত পরিকল্পনা তৈরি করার পাশাপাশি অধিবাসীদের জীবনযাপনে হস্তক্ষেপ কমায়।

 

বেলগ্রেদে কয়েক দশক ধরে বসবাসরত শহরবাসীর জন্য “মাতৃ নদী’ এখন আর ক্ষতির কারণ নয়। এটি আসলে তাঁদের বৃহত্তম প্রত্যাশা ছিল। চীনা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় স্থানীয় দূষিত পানির পরিশোধন ক্ষমতা উন্নত হয়েছে। এটা শুধু তাঁদের জীবনযাপন উন্নত করবে-তা নয়, বরং পরবর্তী প্রজন্মকে উপকৃত করবে। তাঁরা বিশ্বাস করেন, প্রকল্পের মাধ্যমে শহরটির আরো দূষণমুক্ত ও সুন্দর ভবিষ্যত হবে।

 

(প্রেমা/এনাম)